জেদে তৈরি হলো যে বাড়ি

বখতিয়ার আবিদ

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৪:১৭ পিএম

রোজগার্ডেন। ছবি : লেখক

রোজগার্ডেন। ছবি : লেখক

রোজগার্ডেন বা হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি, টিকাটুলী এলাকায় গিয়ে যে নামেই খোঁজ করা হোক সকলেই দেখিয়ে দেবে সাদা রঙের প্রাসাদতুল্য বাড়িটি। এটি তৈরির পেছনে রয়েছে জাত্যাভিমানে অপমানিত হওয়া বিশ শতকের এক ব্যবসায়ী হৃষিকেশ দাসের গল্প। চলুন, ইতিহাস গবেষক হাসেম সূফির মুখ থেকেই শুনে আসি সেই গল্প, ‘‘হৃষিকেশ দাস কখনোই জমিদার ছিলেন না। অনেকেই তাকে জমিদার ভেবে ভুল করেন। তিনি ছিলেন অনেক বড় আকারের ব্যবসায়ী, অনেক জমিদারের চেয়েও বড়।

একবার, গাজীপুরের বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী তার বাগানবাড়িতে ঢাকার সকল মুসলমান ও হিন্দু ভিআইপিকে দাওয়াত করলেন। বর্তমান ওয়ারীর যে বলধাগার্ডেন সেটাই ছিল তখন বাগানবাড়ি। দাওয়াত দেওয়ার ভার পড়ল জমিদারের ম্যানেজারের ওপর। ম্যানেজার তখন ঢাকার ভিআইপিদের একটা লিস্ট তৈরি করলেন, ভিআইপি বলতে ঢাকায় বসবাসরত বিভিন্ন জমিদার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণি। সেই লিস্টে হৃষিকেশ দাসেরও নাম ছিল। তিনিও দাওয়াত পেলেন। তো নির্দিষ্ট দিন হৃষিকেশ দাস গিয়ে নামলেন বলধা গার্ডেনের গেটে, সেখান থেকে তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী তাকে বললেন, ‘আপনাকে তো আমি দাওয়াত দিইনি, আপনি কেন এসেছেন?’ ছোট জাত বলেও অপমান করা হয় তাকে। এ ঘটনা যখন ঘটছে তখন উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিরা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তারা জমিদারকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, হৃষিকেশ দাস এখন অর্থবিত্তের দিক থেকে সমশ্রেণির। এবং সে আপনার দাওয়াত কার্ড পেয়েই এখানে এসেছে। 

অপমানিত হৃষিকেশ দাস ঘোষণা দিলেন, ‘আমি এর চেয়ে বড় বাগানবাড়ি তৈরি করব।’ এরপর তিনি টিকাটুলী ও গোলাপবাগ এলাকায় পাঁচ-ছয়শ বিঘা জমি কেনেন। এতেই তার অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েন। অর্ধেক ভবন তৈরি করে আর কাজ এগিয়ে নিতে পারেন না। তখন হৃষিকেশ দাস অনেকের কাছে লোনের জন্য যান, কিন্তু তারা কেউই টাকা ধার দেন না, কারণ এটা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল, তারা এতে পড়তে চাননি। হৃষিকেশ দাসের একটা সংকল্প ছিল যে, ‘আমি প্রয়োজনে নিঃস্ব হয়ে যাব, কিন্তু এই ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করব এবং এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ঢাকা শহরে জমকালোভাবেই করব।’ বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত অনেকেই যখন ফিরিয়ে দিলেন, তখন ঋণ দিতে এগিয়ে এলেন তার বন্ধু খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশিদ। কলকাতা শহরের কয়েকটি বাড়ি বিক্রি করে আবদুর রশিদ তাকে এই ঋণ দিয়েছিলেন। পরে আবারও ঋণের প্রয়োজন হলে হৃষিকেশ দাস আবদুর রশিদের শরণাপন্ন হন, কিন্তু এবার তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন। তখন হৃষিকেষ দাস বললেন, ‘তুমি বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ করে দাও, এ বাড়িতে আমি উঠব না, আমি এটা তোমার নামে করে দেব, আমার শুধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি দরকার।’ তখন খান বাহাদুর আবদুর রশিদ পুরো বাড়িটি কিনে নেন এবং নির্মাণ কাজ শেষ করেন। তখন ১৯৩৭ সাল, সপরিবারে বাড়িটিতে থাকতে শুরু করেন আবদুর রশিদ। সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে বাড়িটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন আবদুর রশিদ। কিন্তু অতিথিদের আমন্ত্রণ পত্রে শুধুই হৃষিকেশ দাসের নাম দিলেন তিনি। হৃষিকেশ দাসকে সপরিবারে আমন্ত্রিতও করেছিলেন। পুরো অনুষ্ঠানটির তত্ত্বাবধান করেন হৃষিকেশ দাস। 

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় হৃষিকেশ দাস কলকাতায় বাড়ি তৈরি করে চলে যান। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সূত্রাপুরে তার নিজ বাড়িতেই থাকতেন তিনি। তবে একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশিদের পুত্র কাজী হুমায়ুন বশিরের একটি বাড়ি কলকাতায় কিনে নেন হৃষিকেশ দাস। ব্যবসায় উন্নতির ফলে তখন তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। কাজী আবদুর রশিদের মৃত্যুর পর বাড়িটির মালিক হন তার বড় ছেলে কাজী হুমায়ুন বশির। তখন বাড়িটি হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। রোজগার্ডেন বা হুমায়ুন সাহেবের বাড়িটি নির্মাণশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। এর ভিত্তির ওপর ছয়টি বিভিন্ন উচ্চতার খাঁজকাটা থাম রয়েছে। থামের শীর্ষে লতাপাতার নকশা করা। ভবনটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত। এই ভবনের সকল প্রবেশদ্বার কাঠ, রঙিন বেলজীয় কাচ ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি এবং সেগুলো জটিল জ্যামিতিক নকশা, লতাপাতা ও বিভিন্ন প্রাণীর মোটিফে অলংকৃত। 

প্রায় সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত পশ্চিমমুখী দোতলা এ বাড়িটি প্রায় পঁয়তাল্লিশ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। এর সম্মুখভাগ অন্য সকল দিকের চাইতে আকর্ষণীয়। 

রোজগার্ডেন বা হুমায়ুন সাহেবের বাড়িতেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিমলীগ আত্মপ্রকাশ করে। যে দলটি বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh