এহসান হায়দার
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৪২ পিএম
ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে জসীম উদ্দীনের সেই সোজন বাদিয়ার ঘাট (ইনসেটে বইয়ের প্রচ্ছদ)। ছবি: সংগৃহীত
ইতল বেতল ফুলের বনে ফুল ঝুর ঝুর করেরে ভাই।/ফুল ঝুর ঝুর করে;/দেখে এলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে।/ধানের আগায় ধানের ছড়া, তাহার পরে টিয়া,/নমুর মেয়ে গা মাজে রোজ তারির পাখা দিয়া,/দূর্বাবনে রাখলে তারে দূর্বাতে যায় মিশে,/মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।
পঙ্ক্তিগুলি জসীম উদ্দীন রচিত ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ নামক চিরন্তন বাংলার লোক আখ্যান থেকে সংগৃহীত। গ্রন্থটি ১ম প্রকাশ পেয়েছিল ২৮ ফাল্গুন, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ (১৯৩৩ ইং), পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬২। কাব্যগ্রন্থে মোট ছয়টি পর্ব রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নামে-নমুদের কালো মেয়ে, নীড়, পলায়ন, পূর্ব্বরাগ, বেদের বহর, বেদের বসাতি। গ্রন্থটি এতই সুমিষ্ট ছান্দসিক বয়ানে রচিত যে দেশে দেশে সুনাম ছড়িয়েছে আখ্যানটি। যে একবার এটি পাঠ করেছে, সে আর এর প্রেমে না পড়ে পারেনি। যে কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিমূলক সংস্থা ইউনেস্কো জসীম উদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-কে এশীয় সিরিজের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের সম্মাননা দিয়েছে, আর এশীয় সংস্কৃতিস্বরূপ ১৯৯৩ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বার বইটির সংস্করণ সংরক্ষণ করেছে।
মাত্র ৩০ বছর বয়সে লেখা জসীম উদ্দীনের এই কাব্যগ্রন্থ পড়ে প্রশংসা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখেছিলেন-“তোমার ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অতীব প্রশংসার যোগ্য। এ বই যে বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই।” এত যে প্রশংসা, এত আদৃত যে গ্রন্থ, কী রয়েছে সেই কাব্যোপন্যাসে? সেই দিকেই অগ্রসর হই ধীরে।
গ্রন্থ পাঠের পর আগ্রহের কারণে কিংবদন্তির সোজন বাদিয়ার ঘাটের খোঁজ এ সময়ের প্রজন্মের অনেকেই করে থাকেন। কবির জন্মস্থান ফরিদপুর। সোজন বাদিয়ার ঘাটটিও এই ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে। গুগল ম্যাপে এই ঘাটের সাম্প্রতিক কিছু স্থিরচিত্র পাওয়া যায়, এর বাইরে এ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য আমরা পাই না। তবে নানা মাধ্যমে খোঁজ-খবর করে ফরিদপুরের কয়েকজন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অম্বিকাপুর ইউনিয়নে কুমার নদের পাড়ে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অবস্থিত। পূর্বের সেই রূপ আর নেই নদের, মরা নদের কূলে এই ঘাট এখন জীর্ণ-শীর্ণ রূপে তার কিংবদন্তির গল্প নিয়ে কংকাল হয়ে পড়ে আছে। অম্বিকাপুর রেলস্টেশনের খুব কাছেই এই ঘাট, সরেজমিনে দেখা মেলে স্থানীয় প্রশাসন থেকে একটি নামফলক রয়েছে এই ঘাটের। যদিও জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে অনেকবারই এই ঘাট সংস্কারের কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এখনো।
জসীম উদ্দীন রচিত কাব্যোপন্যাসে রয়েছে-শিমুলতলী গ্রামে বসবাস করা হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায় মিলেমিশে বসবাস করত। তাদের মধ্যে ছিল সম্প্রীতি, যা ভ্রাতৃত্বের চেয়েও বেশি। দেখা যায় মুসলিম বাড়িতে কেউ মারা গেলে তার জন্য হিন্দুবাড়ির তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে। আবার হিন্দুবাড়িতে কারও সন্তান অসুস্থ হলে, তার জন্য পানি পড়া দেন মুসলিম পীর/মৌলবী সাহেব। সহজভাবে বললে বোঝায়, পুরো গ্রামটি মিলে যেন একটি পরিবার। এ গ্রামের প্রত্যেকেই অপরের শুভাকাঙ্ক্ষী। এই গ্রামেরই নমুদের নেতা গদাই মোড়লের চঞ্চল কন্যা দুলালী, যার ডাকনাম দুলী। সদা উড়ে বেড়ানো পাখির ন্যায় দুলীও ঘুরে বেড়ায় পুরো গ্রাম জুড়ে। তার সব সময়ের সাথি একই গ্রামের দমির শেখের ছেলে সোজন। ছোটবেলা থেকেই একে অপরের খেলার সাথি, একে অপরের পরম আপনজন। সোজন কখনো পেছন থেকে দুলীকে ডাক দিলে, দুলীর পাকা আম কুড়িয়ে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়। দুলীর ইচ্ছে হয়, সিঁদুরের কৌটোয় সোজনকে আপন করে লুকিয়ে রাখতে। সোজনের ইচ্ছে বড় হয়ে তার বাড়ির আঙিনায় কুমড়ো চাষ করবে, তবে তা সবজির জন্য নয়, দুলী যদি শখের বসে একটি কুমড়ো ফুল খোঁপায় বাঁধে! এভাবেই এক মোহনীয় প্রেমের আখ্যান লিখেছেন কবি, যা সত্যি এবং বাস্তব। কিন্তু এ গল্প রূপ নেয় দুঃখ সাগরে, পরিণত বয়সে সোজন এবং দুলী হয়ে যায় আলাদা। দুলীর অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়। তখন দুলী বুঝতে পারে যে তার ছোটবেলার খেলার সাথি সোজনকে ছেড়ে যেতে পারবে না। সে তার মন সোজনকে দিয়ে ফেলেছে, চাইলেই কুমড়োর ফালির মতো কেটে কেটে সবাইকে বিতরণ করতে পারবে না। বিয়ের দিনে দুলী, সোজনকে আড়ালে ডেকে তার মনের কথা খুলে বলে। সোজনের নিজের সঙ্গে মিলে গেলেও সে তার পরিবার, সম্প্রদায়ের কথা ভেবে দুলীকে বোঝাতে চেষ্টা করে। এবং যখন দুলী আকাশ-বাতাস সাক্ষী রেখে সোজনকে স্বামী বলে ঘোষণা করে তখন আর সোজনের কিছুই করার থাকে না। এ রকমভাবে গড়ে ওঠা এই কাহিনির শেষটা এই ঘাটেই ঘটে, সোজন বাদিয়ার বহর চলতে থাকে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় দুজনের জীবন, সোজন এবং দুলীর এই বিচ্ছিন্নতার কারণে হাহাকার করে ওঠে পাঠক হৃদয়।
সোজনের বসবাসের এই ঘাটকে ঘিরে সেই গল্প আজও মানুষকে পুরনো দিনে নিয়ে যায়। স্থানীয় মানুষজন বলেন, প্রায়ই কোনো না কোনো লোক এই ঘাট দেখতে আসেন। কবি জসীম উদ্দীনের রচনাস্মৃতির জন্য যেমন এটির সংরক্ষণ প্রয়োজন, ঠিক তেমন করে কিংবদন্তির গল্পটির জন্যও এর সংরক্ষণ প্রয়োজন। না হলে যুগের পর যুগ নতুন প্রজন্ম, আগ্রহী গবেষকÑকীভাবে দেখতে পারবে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’?