আইনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে যা বলা আছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৪, ১১:৫৭ এএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০১:৪২ পিএম

বাংলাদেশের সংবিধান। প্রতীকী ছবি।

বাংলাদেশের সংবিধান। প্রতীকী ছবি।

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ইতোমধ্যেই সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং রাজনৈতিক দলের নেতার প্রস্তাব অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। বাকি সদস্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলেই এ সরকার গঠিত হবে।

রাজনৈতিক নেতারা ও কোটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বললেও বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। সংবিধানে কেবল নির্বাচিত সরকারের কথাই বলা আছে। নির্বাচিত সরকারের বিকল্প হিসেবে আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি থাকলেও উচ্চ আদালত তাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। পরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ২০০৯-১৪ মেয়াদের সময় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাতিল হয়।

ফলে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিকালীন সরকারের বিধানটি না থাকায় এটি কীভাবে গঠিত হবে, তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন জেগেছে। অবশ্য বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অস্থায়ী সরকারের প্রধান হওয়ার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাষ্ট্রের ক্লান্তিকালে এ ধরনের একটি বিধান করা যেতেই পারে। তবে সংবিধানে ভবিষ্যতে এর বৈধতা দিতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন
গণরোষের মুখে সোমবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি পদত্যাগ করায় মন্ত্রিসভাও ভেঙে গেছে। পরদিন মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাংবিধানিক সরকার কাঠামো দরকার হয়, সেটি এখন বিদ্যমান নেই। সে কারণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরপরই  সংসদ ভেঙে দিয়ে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠনের তাগিদ দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।

মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, কালবিলম্ব না করে আজকের মধ্যেই পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করুন। অন্যথায় দেশে আবার রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নাম চূড়ান্ত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে বাকি নামগুলো চূড়ান্ত করা হবে বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে বাকি সদস্যদের নাম চূড়ান্ত হবে। বাকি সদস্যদের বিষয়টি সুরাহা হলেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

সংবিধানে কি আছে
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নামে কোনো ব্যবস্থার উল্লেখ নেই। তবে কাছাকাছি ধরনের একটি ব্যবস্থার কথা আগে বলা ছিলো, যেটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা নামে পরিচিত।

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান-সংবলিত বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আইন, ১৯৯৬ সালে পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ ভাগে ‘২ক পরিচ্ছদ: নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামে নতুন পরিচ্ছেদ যোগ হয়।

এতে ৫৮ক, ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ নামে নতুন অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ এর অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ কার্যক্রম ও মেয়াদকালসহ বিস্তারিত বিষয়ে উল্লেখ ছিলো। পরে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করার প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে ৩০ জুন এই ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ে পরবর্তী দুই মেয়াদে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিলো। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে বাইরে রাখার কথা বলা হয়। যদিও রায়ের ওই পরামর্শটি অনুসরণ না করেই ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া রায়ের দেড় মাসের মাথায় ওই বছরই ৩০ জুন সংবিধান সংশোধন করে পদ্ধতিটি একেবারেই বাতিল করে দেওয়া হয়। সাধারণত চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলেও, এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছিলো পরের বছর ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর।

বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

কিন্তু নির্বাচন ছাড়াই হুট করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায় বর্তমানে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটি বিবেচনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি উঠেছে। তবে এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছুই বলা না থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঘিরে আইনি একধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিশেষ সময়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অনেক সময় অনেক কিছু করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ রকম একটি বিধান করা যেতেই পারে। তবে এ ব্যাপারে অবশ্যই ভবিষ্যতে এর সাংবিধানিক বৈধতা দিতে হবে।

এ বিষয়ে তিনি ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদকে অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি করার প্রসঙ্গটি টানেন।

উল্লেখ্য, গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিলো।

সে জন্য বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই বিষয়টি বৈধতা দেওয়া হয়েছিলো সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh