দিল্লির আখড়া: যেখানে দানবেরা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৫৩ পিএম

দিল্লির আখড়া। ছবি: সংগৃহীত

দিল্লির আখড়া। ছবি: সংগৃহীত

নাম দিল্লির আখড়া, কিন্তু বাস্তবে ভারতের দিল্লির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত এর অবস্থান কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার শেষ প্রান্তে কাটখাল ইউনিয়নে। জেলার ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরনো এই আখড়াটি। জানা যায়, তৎকালীন দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সাধক নারায়ণ গোস্বামী এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

দিল্লির আখড়ার দুপাশে দুটি পুকুর এবং নদীর তীর ঘেঁষা প্রাচীন দেয়াল ও অট্টালিকার পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রায় তিন হাজার হিজল গাছ শোভা ছড়িয়ে আছে। নদীর তীরে ঐতিহাসিক এই আখড়া ও হিজল গাছগুলো মিঠামইন হাওরের সৌন্দর্যে যোগ করেছে বিশেষ বৈচিত্র্য। ভেতরের অপূর্ব দৃশ্য ও নিরিবিলি পরিবেশ সবার নজর কাড়বে। আখড়ার ভেতরে ধর্মশালা, নাটমন্দির, অতিথিশালা, পাকশালা, বৈষ্ণবদের থাকার ঘর, সাধক নারায়ণ গোস্বামী এবং তার অন্যতম শিষ্য গঙ্গারাম গোস্বামীর সমাধি রয়েছে।

কিছু মিথ

হিজল গাছ ও দিল্লির আখড়াকে নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে গা ছমছম কিছু গল্প প্রচলিত। সাধক নারায়ণ গোস্বামী ছিলেন পার্শ্ববর্তী বিতলঙ্গের আখড়ার আধ্যাত্মিক সাধক রামকৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য। তৎকালীন সময় চতুর্দিকে নদী পরিবেষ্টিত এই এলাকা ঘন ঝোপ-জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। রহস্যজনক কারণে এই এলাকার নদীপথে গমনকারী নৌকাগুলো ডুবে যেত অথবা দুর্ঘটনার শিকার হতো। একদিন দিল্লির সম্রাট প্রেরিত একটি কোষা নৌকা এই নদীপথে যাওয়ার সময় মালামালসহ ডুবে যায়। আরোহীরা অনেক চেষ্টার পরও কোষাটি উঠাতে ব্যর্থ হন। নৌকার যাত্রীদের একজন সাপের কামড়ে মারা যান। বিতলঙ্গের সাধক রামকৃষ্ণ এই খবর পেয়ে শিষ্য নারায়ণ গোস্বামীকে দুর্ঘটনাকবলিত স্থানে যেতে নির্দেশ দেন। গুরুর আদেশে সাধক নারায়ণ গোস্বামী নদীর তীরে তপস্যায় বসেন। এ সময় কোনো এক অলৌকিক শক্তি তাকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। তবে সাধক নারায়ণ গোস্বামী তার সাধনাবলে তীরে আসতে সক্ষম হন। এভাবে পরপর ৭ দিন একই ঘটনা ঘটে।

এরপর একদিন দৈব বাণীর মতো নারায়ণ গোস্বামীকে এই স্থান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়। উত্তরে সাধক তাদের পরিচয় ও দর্শন চান। দৈব কণ্ঠ নিজেকে এখানকার বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে দানব মূর্তি ধারণ করে। নারায়ণ গোস্বামী দেখতে পেলেন চারপাশে হাজার হাজার বিশালাকার দানব দৃশ্যমান হয়েছে। সাধক নারায়ণ গোস্বামী দানবদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নেন যে, তারা মানুষের ক্ষতি না করে বসবাস করবে। সাধক নারায়ণ গোস্বামীর নির্দেশ মেনে দানবেরা হিজল গাছে পরিণত হয়।

পরে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর ঐশী ক্ষমতা বলে সেই ডুবে যাওয়া কোষাটি মালামালসহ উঠিয়ে দেয় এবং সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তিটিকেও বাঁচিয়ে তোলেন। পরে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে এ খবর পৌঁছার পর তিনি সাধক নারায়ণ গোস্বামীর নামে প্রায় ৪০০ একর বিশাল এলাকা দান করে দিয়ে একটি আখড়া প্রতিষ্ঠা করে দেন। এরপর থেকে আখড়াটি দিল্লির আখড়া নামে পরিচিতি লাভ করে। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১২১২ সালে আখড়ার নামে একটি তামার পাত্রে উক্ত জমি লিখে দেন। কিন্তু ১৩৭০ সালে ডাকাতরা এই পাত্রটি নিয়ে যায় বলে আখড়ার সেবায়েতরা জানান। 

নারায়ণ গোস্বামী যে দানব প্রধানের গাছের রূপের নিচে বসে সাধন শুরু করেন সেই সাধনার জায়গা ‘সাধনবৃক্ষ’ বর্তমানে পাকা বেষ্টনী করে রাখা হয়েছে। প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে এখানে ভোগ দেওয়া হয়। প্রতিবছর ৮ চৈত্র এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলের সবাই মেতে ওঠেন উৎসব-আয়োজনে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh