অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৪, ০৮:০৯ পিএম
ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের সমাবেশে সংগঠনটির রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া। ফাইল ছবি
এবারই যে প্রথম, তা নয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বহুজাতিক সংঘাতের আশঙ্কা গত ১০ মাস ধরেই বিরাজ করছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল সামরিক আগ্রাসন শুরুর দিন থেকেই এমন আতঙ্ক রয়েছে ওই অঞ্চলে। কারণ লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরান সরকার শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রয়েছে এবং ওই দিন থেকেই গাজার পাশাপাশি হামাসের এই মিত্র শক্তিদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে যুদ্ধবাদী ইসরায়েল।
কিন্তু এ বছর ৩০ থেকে ৩১ জুলাই-মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে হিজবুল্লাহ ও হামাসের দুই শীর্ষ নেতাকে যথাক্রমে লেবানন ও ইরানের মাটিতে ইসরায়েল হত্যা করার মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রথম দিন বৈরুতে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে হত্যা করে ইসরায়েল। এর পরদিন তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে তারা।
এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো লেবানন থেকে তাদের নাগরিকদের অবিলম্বে যে কোনো উপায়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ হিজবুল্লাহ জানিয়ে দিয়েছে, ফুয়াদ হত্যার দাঁতভাঙা জবাব না দিয়ে তারা ক্ষান্ত হবে না। অন্যদিকে তেহরানে হানিয়াকে হত্যা করায় ইসরায়েলে কঠোর হামলার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এবং এরা যে শুধু ফাঁকা বুলি ছোড়ে, তা নয়। বরং নিকট অতীতেও বলে-কয়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামলা করতে দেখা গেছে ইরান ও হিজবুল্লাহকে।
গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে দীর্ঘদিনের মিত্রতা রয়েছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী ও বড় রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহর। অন্যদিকে শিয়া হলেও ইরান অস্ত্র, আশ্রয় ও কৌশল দিয়ে সুন্নিবাদী হামাসকে সহযোগিতা করে। হানিয়া হত্যায় সবার নজরই এখন ইসরায়েলের ওপর, যে দেশটি হামাসের সব নেতাকে খুঁজে খুঁজে বের করে সাজা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তা ছাড়া ইরানে এর আগে ইসরায়েলের হামলা চালানোর নজিরও আছে। ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্র ঘিরে আকাশ প্রতিরক্ষার ওপর ইসরায়েল যে ধাঁচে হমলা চালিয়েছিল, সেই একই কায়দায় সম্ভবত এবার হামলা চালিয়ে হানিয়াকে হত্যা করেছে তারা।
হানিয়া খুন হওয়ার পর হামাসের সশস্ত্র শাখা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘হানিয়া হত্যাকাণ্ড যুদ্ধকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে এবং এর প্রতিক্রিয়াও বড় ধরনের হবে।’ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, এ ঘটনায় ইসরায়েল নিজেদের জন্যই কঠোর শাস্তি বেছে নিয়েছে। হামাস নেতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া তেহরানের কর্তব্য, যেহেতু তার মৃত্যু হয়েছে ইরানের মাটিতে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এমন যুদ্ধ এড়ানো হয়তো অসম্ভব নয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, ওয়াশিংটন উত্তেজনা কমাতে কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, যুদ্ধ অনিবার্য। কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ সব সময়ই আছে বলে আমি মনে করি।’ শুরু থেকেই গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন মনে করে, হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু তুরস্ক মনে করে, হামাস ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সংগঠন। সম্প্রতি তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান হুঁশিয়ারি করেছেন, প্রয়োজনে তার দেশ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকবে। তিনি ইসরায়েলি যুদ্ধবাদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে সাবেক জার্মান স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল অবশ্য এরদোগানকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছে। এরদোগানকে তারা ইরাকের সাবেক একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তুলনা করে বলেছে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার পরিণতিও অমন হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্য পুরোদস্তুর যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু বাড়তি যুদ্ধ আসলে কে চায়? কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। তাদের একটাই লক্ষ্য, যেন যুদ্ধ আর না ছড়ায়। যেমন-জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহে তেহরান সফর করেছেন, ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরির সঙ্গে বৈঠক করে তাকে সম্ভাব্য হামলা করা থেকে ইরানকে বিরত থাকার অনুরোধ করেছেন তিনি। অন্যদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে ফোন করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্ভাব্য করণীয় বিষয়ে আলাপ করেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ আছে যে, পশ্চিমারাই বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে।