রেখে গেলেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি বধ্যভূমি

আদর চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০৫:২১ পিএম

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির গুলিতে সারা দেশে লাশের মিছিল। ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির গুলিতে সারা দেশে লাশের মিছিল। ছবি: সংগৃহীত

এক নদী রক্তে নৌকা ভাসিয়ে পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। রেখে গেলেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি বধ্যভূমি, আর মাথাপিছু তেষট্টি হাজার টাকার ঋণের বোঝা। গত ১৫ বছর ধরে সংবিধানের ধারায় মোড়ানো স্বৈরতন্ত্রের যে নতুন অধ্যায় রচনা করেছিলেন শেখ হাসিনা, তা যদি বিশ্বের তাবড় তাবড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে পড়ানো হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। স্বৈরতন্ত্রের ধারাটি গড়ে তোলা হয়েছিল তিনটি সাজানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সংবিধান সংশোধন করে এমনভাবে সরকারের বৈধতার বিষয়টি সামনে তুলে ধরা হতো তাতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই বদলে যেত!

শেখ হাসিনা নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মতামত চাপিয়ে দিয়েছেন সত্যজিতের হীরক রাজার মতো। হীরক রাজার মতোই যে মন্ত্রিসভা তথা সভাসদের আসর তার ছিল, তারা সকলে ‘ঠিক ঠিক’ বলে মাথা দুলিয়ে গেছেন তার সকল গণবিরোধী মতামতের পক্ষে। বাকি রইল পাইক-পেয়াদা-সে গল্প বলতে গেলে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। 

শেখ হাসিনার পতন হয়েছে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে; কিন্তু একদা জনগণই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। তার রাজনৈতিক উত্থান ছিল বেশ ঘটনাবহুল আর স্ববিরোধিতায় ভরপুর। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেছিলেন সম্পূর্ণ এক নতুন পরিচয়ে। রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে সেবারই তার উত্থান, হাল ধরেছিলেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার দলও শামিল হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের মাঝপথে ১৯৮৬ সালে এরশাদের সাজানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে সকলকে অবাক করে দেন। সেবার তথাকথিত বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে আবার তিনি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বৈরাচার এরশাদ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর! তখন ১৯৯৬ সাল। তারপর রাজনৈতিকভাবে তারা দীর্ঘ পথ চলেছেন। একসঙ্গে সরকারে থেকেছেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এরশাদকে মুক্ত ও সংসদে জোট করা ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করে চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। এক সময় জামায়াতের সঙ্গে জোট ভেঙে যায়। তারপর থেকে শেখ হাসিনা ও তার দলের সরকার পতন হওয়া পর্যন্ত জামায়াতের বিপক্ষে অবস্থান ছিল স্পষ্ট। এমন নানা স্ববিরোধিতাকে রাজনীতির ভাষায় যৎকালে তৎবিবেচনা বলা যেতে পারে। এটাকে রাজনৈতিক খেলাও বলে থাকেন অনেকে। 

শেখ হাসিনার অনুসারীরা নানাভাবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে গর্ব করেই বলতেন যে, এই খেলায় শেখ হাসিনা পাকা খেলোয়াড়। কিন্তু রাজনীতির মাঠের এমন পাকা খেলোয়াড় ১৫ বছরের টানা শাসনেও জনগণের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয়তো বুঝতে চাননি। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে যখন পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির গুলিতে সারা দেশে লাশের মিছিল বাড়ছিল, তখনো ছাত্র-জনতা নতুন উদ্যমে আবার বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। তখনো তিনি মানতে চাইছিলেন না জনগণ তার বিপক্ষে চলে গেছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার এই আপ্রাণ চেষ্টা, বিশাল অংশের জনগণকে শত্রুজ্ঞান করে বিমাতা সুলভ এই আচরণ স্বৈরশাসনেরই নামান্তর। রাজনীতির মাঠে জনগণকে যে রাজনীতিবিদ শত্রুজ্ঞান করেন, তিনি আদৌ কি রাজনীতিটা করেন? শেখ হাসিনার বেলায় এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে শেষ বেলায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh