নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১১:২৮ এএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩২ এএম
সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একের পর এক থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যারা সবচেয়ে দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন, ক্ষমতার পালা বদলের পর দেখা গেল সে তত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি সালমান এফ রহমানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। জানা গেছে, সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে নামে-বেনামে অনেক ব্যাংক থেকে নিয়মবহিভূর্ত ঋণ নিয়েছেন।
জানা গেছে, এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো আইন। পর্যাপ্ত জামানতও নেই অধিকাংশ ঋণে। আবার বছরের পর বছর ঋণের অর্থ পরিশোধ না করেই বারবার করেছেন পুনঃতপশিল। সবমিলিয়ে ব্যাংক খাতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এই বিনিয়োগ উপদেষ্টা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি সাতটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অপরাধ জেনেও চুপ ছিল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই এসব ঋণ এখন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ ঋণই খেলাপির ঝুঁকি রয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, যে কোনো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ক্যাশ ফ্লো বিবেচনায় নেওয়া হয়। মূলত ঋণ কীভাবে ফেরত আসবে বা ঋণ শোধের ম্যাকানিজম হিসেবে ক্যাশ ফ্লো আছে কি না, সেটি দেখা হয়। এরপর ওই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত নেওয়া হয়। তবে সহায়ক জামানতের বিষয়টি যাদের ‘আমি চিনি না’, তাদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য হয়। আবার বড়দের সবাই ঋণ দিতে এতই আগ্রহী থাকে যে, সহায়ক জামানত চাওয়ার সুযোগও থাকে না। এ ক্ষেত্রে এসব ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়েও শঙ্কা বেশি থাকে।
কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, রাজনৈতিকভাবে এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে, কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাদের কিছু বলা যেত না। বাংলাদেশ ব্যাংকও জেনে চুপচাপ ছিল। তাই এসব ঋণ দীর্ঘদিন আদায় ছাড়াই পড়ে আছে। এসব ঋণের অধিকাংশই খেলাপি যোগ্য। ঋণগুলো পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া দেওয়ার কারণে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
তারা আরও বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এখন যদি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, তাহলে কিছু টাকা হলেও উদ্ধার করা যাবে। তাই সরকারের উচিত হবে এসব ঋণের ব্যাপারে নজর দেওয়া।
যে সাত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান-
জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ
সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ বের করেছেন। এই ব্যাংকে বেশিরভাগ ঋণই ছিল তার বেনামি। এতদিন তার নামে জনতা ব্যাংকে থাকা ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা দেখিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তার ২৯ প্রতিষ্ঠানে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসে।
২০২৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে সালমান এফ রহমানের দুই প্রতিষ্ঠানে ২৩ হাজার ৭০ কোটি টাকার ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ২০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। ফান্ডেড ২০ হাজার ২০৮ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৫৪৪ কোটি টাকা। বেক্সিমকো লিমিটেডে ফান্ডেড ১ হাজার ৯৯৪ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৩২৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একক গ্রাহককে মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) বেশি ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ সুবিধা দিয়েছে।
আইএফআইসি থেকেও নামে-বেনামে ঋণ
সালমান এফ রহমান নিজের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রীপুর টাউনশিপ প্রতিষ্ঠানের নামে নন-ফান্ডেড ১ হাজার ২০ কোটি টাকা, সানস্টার বিজনেসের নামে ৬১৫ কোটি, ফারেস্ট বিজনেসের নামে ৬১৪ কোটি, কসমস কমোডিটিস লিমিটেডের নামে ৬১২ কোটি, অ্যাপোলো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ৪৫৫ কোটি, আল্ট্রন ট্রেডিং লিমিটেডের নামে ৪৪৯ কোটি, নর্থস্টোন কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪২১ কোটি, আলফা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নামে ৫৬৯ কোটি ও অ্যাবসলিউট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪৬৩ কোটি টাকার ঋণ নেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বেনামি।
বাদ যায়নি ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক
বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে ঋণ বের করে নিয়েছেন। ব্যাংকটি থেকে এসব ঋণ বহু বছর আগের। কোনো অর্থ পরিশোধ না করেই নিয়মিত থেকে যাচ্ছেন।
জানা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ফান্ডেড ৮৩৬ কোটি টাকা, বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ফান্ডেড ৮২৩ কোটি, বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ১ ও ২ অনুকূলে ফান্ডেড ১ হাজার ২৩৪ ও নন-ফান্ডেড ৫৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন।
সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে দীর্ঘদিনের ঋণ
তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেডের ফান্ডেড ৬৬৩ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড নিয়েছে ফান্ডেড ৩৭৫ কোটি টাকা এবং বেক্সিমকো কমিউনিকেশন লিমিটেড ফান্ডেড ৩০০ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৭১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। রূপালী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেডে ৯৬৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুনর্গঠিত ঋণ ১ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এসব ঋণ পরিশোধ না করার পরও নিয়মিত রয়েছে। অথচ পুনর্গঠিত ঋণের দুই কিস্তি পরিশোধ না করলেই ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার কথা।
এবি ব্যাংকে রয়েছে চার প্রতিষ্ঠানের ঋণ
এবি ব্যাংকে সালমান এফ রহমানের চার প্রতিষ্ঠান ঋণ রয়েছে। সবগুলো ঋণই পুনর্গঠিত। এ ব্যাংকের ঋণও বছরের পর বছর পরিশোধ করা হয়নি। ঋণগুলো ২০১৫ সালে পুনর্গঠিত করা হয়। বর্তমানে চার প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের ১২০ কোটি। একই প্রতিষ্ঠানে আরও ৫৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলের ৮৩ কোটি এবং নিউ ঢাক্কা ইন্ডাস্ট্রিজের ৩৪৫ কোটি টাকা।
আরও যত কেলেঙ্কারি
সালমান এফ রহমানের নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারে এমন কোনো বড় কেলেঙ্কারি হয়নি; যার সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা নেই। তিনি গত ৩ বছরে দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। অদৃশ্যসহ ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন। এক মুদি দোকানিকে খুনের মামলায় মঙ্গলবার রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে তাকেসহ সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল।