অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে

রইসউদ্দিন আরিফ

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৬:৪৩ পিএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৭:২৩ পিএম

রইসউদ্দিন আরিফ। ফাইল ছবি

রইসউদ্দিন আরিফ। ফাইল ছবি

ইতিহাসের অমোঘ শিক্ষা অনুযায়ী যা ঘটার, তাই ঘটল আজকের বাংলাদেশে। পরাশক্তির আশীর্বাদপুষ্ট দোর্দণ্ড ক্ষমতাশালী এক একনায়কের প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটল মাত্র ১৫ দিনের আন্দোলনের মুখে। এই অসাধ্য সাধন করল যারা, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নয়, কোনো বিপ্লবী পার্টিও নয়। তারা হলো দেশের নতুন প্রজন্মের টগবগে তরুণ ছাত্রসমাজ। অতীতে জাতির চরম সংকট মুহূর্তে অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম-লড়াইয়ে তরুণ ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

এবারও ফ্যাসিস্ট শক্তির স্বৈরাচার এবং তার বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করল তরুণ ছাত্ররাই-যা অতীতের লড়াইগুলো থেকে ভিন্ন এবং ব্যতিক্রমিকভাবে অভিনব। বলা যায়, এদেশে ও উপমহাদেশের কোথাও একশ বছরেও যা কেউ করতে পারেনি, সেই অসাধ্য সাধন করল বাংলাদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ।

তবে তরুণদের দ্বারা প্রবল পরাক্রমশালী এই শক্তিকে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে উৎখাত করা সম্ভব হতো না, যদি তারা দেশের সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন ও সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা না পেত। জনগণের শক্তিই যে সবচেয়ে বড় শক্তি, তা আবারও প্রমাণ হলো। সেই সঙ্গে আরেক সত্য প্রমাণ হলো-এই বিশাল ‘বিপ্লব’টি সম্পন্ন হলো ছাত্র-জনতার নিরস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। আবার এই গণ-অভ্যুত্থান অবিশ্বাস্যভাবে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে সফল হতে পারত না, যদি আমাদের বিরল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সমর্থন এবং ছাত্র-যুবাদের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও মমত্ববোধ না থাকত। সে হিসেবে এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিপ্লবী। বলা যায়, সবকিছু মিলে এটি হলো একটি পরিপূর্ণ সফল গণ-অভ্যুত্থান। 

তা ছাড়া এই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আরেকটি শিক্ষা পাওয়া গেল, সেটি হলো শুধুমাত্র বহির্শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তির লড়াই বাদে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তনের বিপ্লবে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানই হলো যথাযথ কার্যকর পন্থা। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ফয়সালায় উগ্র সশস্ত্র লড়াই ও জঙ্গিবাদ ভুল প্রমাণ হলো নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কাছে। 

আমরা যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণক্ষমতায়নের কথা বলতাম, তারা সেই কাঙ্ক্ষিত অভ্যুত্থানটি কখন, কীভাবে সংঘটিত করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি। এবারের ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই অভিজ্ঞতা আমাদের অর্জিত হলো। তবে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক শূন্যতা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে তরুণ ছাত্রসমাজ যদি সাহস ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে সঠিক মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াত, তাহলে অভ্যুত্থান ঘটতে পারত না। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাস্তবতায় এটি এক অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে তুলে রাখতে চাই সেটি হলো, বিপ্লবী তত্ত্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের আজকের এই গণ-অভ্যুত্থানটি একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলেও-একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বে-হাত হয়ে যাওয়ার কারণে জনগণের সত্যিকারের জাতীয় মুক্তির বিপ্লব এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তাই জাতীয় মুক্তির বিপ্লব সম্পূর্ণ করা যে, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অবশ্য পূর্বশর্ত, এ কথা প্রতিমুহূর্তে আমাদের মনে রাখা জরুরি। তা না হলে আমাদের আম ও ছালা দুটোই খোয়া যাবে। মনে রাখতে হবে জাতীয় সার্বভৌমত্বের সংকট এখনো আমাদের মাথার উপর খাড়া। 

সবশেষে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরে আলোচনার ইতি টানব। সদ্য-পতিত সরকার দীর্ঘ ১৫ বছরে রাষ্ট্রের সর্বত্র অবাধে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট ও বিদেশে হাজার হাজার (মতান্তরে লাখ লাখ) কোটি অর্থপাচারের সুযোগ প্রদান করে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আইন ও বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, ব্যাংক ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেভাবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণনিপীড়নের আখড়ায় পরিণত করেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জঞ্জালমুক্ত করা এক দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এই জঞ্জাল মুক্ত না করে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশ আবারও খাদের মধ্যে নিপতিত হবে। 

দেশে ইতিমধ্যে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধান মোতাবেক অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আজ যেটি ঘটেছে, সেটিকে নির্দ্বিধায় বলা যায় এক ‘বিপ্লব’। সে হিসেবে এখনকার সরকারকেও বলা যায় ‘অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার’। এ রকম একটি বিপ্লবী সরকারকে কথিত সাংবিধানিক আইনের মারপ্যাঁচের মধ্যে ফেলে বিচার করলে, সেটি দেশ ও জনগণের জন্য হবে এক ভয়ংকর অশনিসংকেত। একটি ভয়ংকর স্বৈরাচারী সরকারকে যদি আমরা দীর্ঘ ১৬ বছর সময় দিতে পারি, তাহলে একটি অন্তর্বর্তী গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সরকারকে আমরা প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ৪-৫ বছর সময় দিতে পারব না কেন? ধৈর্য ও শৌর্যই হলো এখন আমাদের নতুন যাত্রার মূল শক্তি।

রইসউদ্দিন আরিফ
লেখক ও গবেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh