ফয়সাল শামীম, কুড়িগ্রাম
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০৪:৫৭ পিএম
ভাঙনে ঘর-বাড়ি ও ফসলী জমি হারাচ্ছে পরিবারগুলো।
বন্যার পানি কমার সাথে সাথে কুড়িগ্রামে তীব্র হয়ে উঠেছে নদ-নদীর ভাঙন। এতে করে চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে ভাঙনে ভিটে-মাটিসহ ঘর-বাড়ি ও ফসলী জমি হারানো পরিবারগুলো। আর নির্ঘুম সময় পাড় করছেন হুমকিতে থাকা পরিবারগুলো।
এদিকে প্রতিনিয়ত ভাঙনের কবলে পড়ে নদী পাড়ের মানুষেরা নিঃস্ব পয়ে পড়লেও টনক নড়ছে না স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মাসের দুই জুলাই থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কুড়িগ্রাম জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে করে তলিয়ে যায় জেলার ৯ উপজেলার প্রায় ৫৫টি ইউনিয়ন। সেই বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোড সূত্র জানায়, অন্তত ৫০টির বেশি পয়েন্টে অব্যাহত রয়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও গঙ্গাধরের ভাঙন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে রলাকাটা চরের প্রায় ৫০টি পরিবার।
স্থানীয়রা জানান, এই চরে শতাধিক পরিবারের বসবাস থাকলেও প্রায় ৫০টি পরিবার নদের ভাঙনের শিকার হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। আর বাকি ৫০টি পরিবারের ঘর-বাড়িও হুমকিতে রয়েছে। প্রতিদিনই ভাঙছে কারো না কারো ঘর-বাড়ি, গাছপালা অথবা ফসলী জমি। একই ইউনিয়নের বড়ুয়া, ভগবতীপুরসহ আরো কয়েকটি চরে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে রৌমারী উপজেলার সোনাপুর, ফলুয়ারচর ঘাট, কোদালকাটি, চিলমারীর শাখাহাতি, অষ্টমিরচরসহ বিভিন্ন এলাকায়।
অন্যদিকে তিস্তার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাবখাঁ, কালিরহাট, উলিপুর উপজেলার সাদুয়া ধামারহাট, থেতরাইসহ বামতীরের বিভিন্ন এলাকা। ধরলার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে সদর উপজেলা আরাজী পলাশবাড়ী, জয়কুমার, সারডোব, চরসিতাইঝাড়সহ বেগমগন্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা।
এছাড়াও নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নে অব্যাহত রয়েছে দুধকুমার ও গঙ্গাধরের ভাঙন। বন্যার পানির তোড়ে বিধ্বস্ত হয়ে আছে নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে দুধকুমারের প্রায় ২০০ মিটার তীর রক্ষা বাঁধ।
পুরো জেলার প্রায় সবগুলো উপজেলাতেই এসব নদ-নদীর ভাঙনে তান্ডললিলা চললেও তেমন কোন পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ স্থানীয় ও ভুক্তভোগীদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় অস্থায়ী ভিত্তিতে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ফেললেও তা সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাবখাঁ এলাকার আবুল হোসেন জানান, তিস্তার ভাঙনে গত ৩/৪দিনে আমার বাড়িসহ এই এলাকার অন্তত ২০টি বাড়ি নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। ঘরের চালসহ বেড়া ও কিছু গাছ কেটে স্কুলের মাঠে রাখলেও নিজেদের থাকার জায়গা মিলছে না। একেকজন একেক জায় রাত কাটাচ্ছে। নিজস্ব আর কোন জায়গা জমিও নেই। ঘর উঠানোর জন্য জায়গাও পাওয়া যাচ্ছে না।
একই এলাকার জোবেদ আলী জানান, ঘর-বাড়ি, জমিজমা সব গেছে। এখন ভাঙনের মুখে রয়েছে আরো অসংখ্য বাড়ি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধু বিদ্যালয় রক্ষার জন্য অল্প কিছু জিওব্যাগ পাঠিয়েছে। যেগুলোতে বালু ভড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এখনো ফেলা হয়নি। তবে এসব জিওব্যাগ দিয়ে কোন কাজ হবে। আমাদের ঘর-বাড়ি বিলীন হলেও ফোন দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন সাড়া পাইনি।
ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের চর খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ডালিম মিয়া জানান, আমার বিদ্যালয়টি একেবারেই তিস্তার কিনারে পড়েছে। জিওব্যাগ ফেলানো হয়েছে কিন্তু স্রোতের তোড়ে কতক্ষণ টিকবে বলা যাচ্ছে না।
সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রলাকাটার চরের মইনুদ্দিন জানান, এই রলাকাটার চরটিতে প্রায় ১০ বছর ধরে বসবাস করছি। এবার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে আমিসহ ৫০টি পরিবার বিলীন হয়েছে। আমরা মানবেতর জীবন-যাপন করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগ নেই।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, বন্যার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার ইউনিয়নে প্রায় ২ শতাধিক বাড়ি ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের শিকার এসব পরিবারকে মাত্র ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। এখনো ভাঙন অব্যাহত রয়েছে রলাকাটা, বড়ুয়া, ঝুনকারচর, ভগবতীপুর ও পারবতীপুর চরে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে যোগাযোগ করা হলেও এখনো পর্যন্ত কোথাও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, তিস্তার ভাঙন থেকে চরখিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষায় বালু ভর্তি জিওব্যাগ ফেলানো হয়েছে। পাশাপাশি খিতাবখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষায়ও জিওব্যাগের প্রকল্প চলমান রয়েছে। দলদলিয়া ইউনিয়নেও জিওব্যাগ দ্বারা জরুরি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও তিস্তার বাইরেও ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের কিছু এলাকায় ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে যেখানে প্রয়োজন হচ্ছে কাজ করছি।