সেলমা লেগারলফ
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩১ পিএম
গ্রহণ। ছবি: সংগৃহীত
সেলমা লেগারলফ (২০ নভেম্বর ১৮৫৮-১৬ মার্চ ১৯৪০) একজন সুইডিশ লেখক। তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম নারী এবং তা পেয়েছিলেন ১৯০৯ সালে। একটি সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং শৈশবের অনেকটা সময় কাটে নানির কাছে রূপকথার গল্প শুনে। প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন মেয়েদের স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। পাশাপাশি লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে ফালুনে থাকার সময় থেকে তিনি একজন সম্পূর্ণ লেখক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একসময় তার পৈতৃক বাড়িটি হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি তার নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ হতে তা আবার কিনে নেন এবং বাকিটা জীবন সেখানেই কাটিয়ে দেন। তার লেখায় লোককাহিনি, কিংবদন্তি বা কল্পনার আধিক্য বেশি। তবু, তার কাজগুলো থেকে উনিশ শতকের ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের সময় মানুষের পরিস্থিতি এবং সামাজিক জীবনের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। লেগারলফের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর চিত্তাকর্ষী বর্ণনা এবং এর স্বচ্ছ আর পবিত্রতা। অনুবাদ: ওয়াহিদা নুর আফজা।
যাজকপল্লীর কাছে স্টোরহোডেন নামে একটি নিচু এলাকা ছিল। জঙ্গলাকীর্ণ আর পাথুরে। খামার মালিকদের অরুচি হওয়ার মতো যথেষ্ট অনুর্বর। তবে আশপাশের মানুষজন একে একেবারে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেনি। বিশেষ করে নারীকুলের আড্ডার স্থান হিসেবে স্টোরহোডেন বেশ পছন্দসই। পুরনো ব্যারাকের পাশে সেদিন এক জমজমাট আড্ডা বসেছিল। রিজকোট থেকে এসেছিলেন স্টিনা, বার্ডসং থেকে কাজসা, লিটলমার্শ থেকে লিনা, স্কাইপ্যাক থেকে মাজা, ফিনডার্কনেস থেকে বেদা আর ছিল এখানকারই নতুন বউ এলিন। এ ছাড়া আরও দু-তিনজন ছিল। নাম না বলে তাদের বরং কৃষাণী হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
এলাকাটি পাহাড়ি। এই নারীকুলের বাড়িঘরের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এদের নামের মতোই বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাদের বাড়িঘরও পাহাড়ের ধাপে ধাপে। একজনের বাড়ি শুধু জলাধারের পাশে। তবে পাহাড়ের চূড়ায় যার বাড়ি, সেখানে পৌঁছাতে প্রতিদিনই তার কাহিল অবস্থা হয়ে যায়। আবার যার বাড়ি অত ঢালে নয়, দেখা যাবে ঢালের মতো পাহাড় শরতের সূর্যকে সেখান থেকে আড়াল করে রেখেছে। আর ঢালের নিচে পাদদেশের মাটি মূলত পাথুরে আর অনুর্বর। তবে প্রকৃতি অতটা অনুদার নয় বলে মাটির রকমফের হয়েছে। তার পরও এ জায়গা চাষাবাদের অনুকূলে নয়। জমিদারির খাসজমি হলে এখানে হয়তো গরুর খামার হতো; কিন্তু এ মহিলারা দমে যাওয়ার নয় বলে তারা প্রত্যেকে বাড়ির পাশে আলুর চাষ করছিলেন। এ জায়গা তাদের তৈরি করতে হয়েছে কখনো পাথর সরিয়ে, কখনো কবরের মতো গভীর গর্ত খনন করে কিংবা কখনো বা বস্তাভর্তি মাটি এনে তা পাথরের উপর বিছিয়ে দিয়ে। আবার মাটি একটু উর্বর হলেই সেখানে কাঁটাগাছ আর আগাছা পরিষ্কারের যন্ত্রণা ছিল। জমি যখন তৈরি হয়ে যায় আর তাতে আলু ফলতে শুরু করে তখন তো সব ইতিহাস।
প্রতিদিন সকালে স্বামীরা চলে যায় কাজে আর সন্তানেরা স্কুলে। তখন বাড়ির মধ্যে নারীকুল পায় তাদের নিজস্ব সময়। কিছু বয়স্ক মহিলা ছিলেন যাদের সন্তানেরা স্বাবলম্বী, কিন্তু তারা থাকত আমেরিকায়। অল্পবয়সী বাচ্চাকাচ্চাদের মায়েদের এ সময় পাড়া বেড়িয়ে গল্প করার কোনো অবসর নেই। বাদবাকিদের অবস্থা তো আর তা নয়। তাই তারা নিজেদের মধ্যে একাকিত্ব দূর করার জন্য একটি কফির আড্ডার প্রয়োজন বোধ করত, অপেক্ষায় থাকত। এমন নয় যে তাদের ভেতরকার সম্পর্কগুলো খুব উষ্ণ, অকপট, এবং নিঃশর্ত ভালোবাসাপূর্ণ ছিল; কিন্তু বাহ্যিকভাবে তারা একটি সৌহাদ্যপূর্ণ, হৃদ্যতাময় সামাজিকতার বলয় তৈরি করতে পেরেছিল। এতে খুব সহজেই তারা নিজেদের গল্পগুলো বলতে পারত। আসলে যখন পাথুরে পাহাড়ের ধূসর ছায়া চারপাশের উজ্জ্বলতাকে গ্রাস করে ফেলত, তখন ঘরের ভেতরের মানুষগুলোরও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ত। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের মনকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই নিয়ন্ত্রণের শেকল ভাঙার জন্য মানুষ একটি সামাজিক পরিবেশ তৈরি করে নেয়। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সঙ্গ আর সখ্য একাকী মনের বিষণ্ণতাকে শুষে নিতে পারে। তাই একটি শীতল দিনের উষ্ণ আকাঙ্ক্ষা কফি আর আড্ডা। একবার আড্ডা যদি জমে যায় তাহলে সেখানে কতজনের কত কথা; কেউ মনটাকে হালকা করতে চাইছে, কেউ বা চাইছে শেষবার আমেরিকাতে যে চিঠিটা আসলো তার কথা বলতে, আর কেউ কেউ তো এমনিতেই খুব গল্পবাজ আর রসিক, তারা তো চাইবে তাদের এই স্রষ্টাপ্রদত্ত ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে। তাই দিনের প্রথম ভাগে যাদের হাতে সময় ছিল তারা নিজেদের মধ্যে একটি কফির আড্ডার অজুহাত খুঁজতেন। চটজলদি এরকম একটা ছোটখাটো দাওয়াতের আয়োজন করার প্রয়োজনীয় উপকরণ সামগ্রী কারও না কারও ঘরেই থাকত। তাদের সবারই তো কফিপট আর কফি কাপ ছিল, নিজস্ব কোনো গরু না থাকলেও কেউ তার ঘর থেকে দুধ নিয়ে আসতেন; যে গাড়ি দুধ-পনির সরবরাহ করে তার চালককে বলে কেউ কেউ শহরের দোকান থেকে মজাদার বিস্কুট আর কেক আনিয়ে নিতে পারতেন, আর স্থানীয় দোকানদারের কাছে তো কফি আর চিনি সহজলভ্য ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে দাওয়াতের আয়োজনটা সহজ হলেও কঠিন কাজটি ছিল এর পেছনের উপলক্ষ খোঁজা। কোনো উপলক্ষ ছাড়া কাজের দিনে মজা করতে বসলে পাছে লোকে নবাবের বেটি নয়তো অপোগণ্ড বলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে পারে। তারাই বা লোকের চোখে অশোভনীয় হবে কেন? এদিকে রোববার বা ছুটির দিনে কফির আড্ডা বসানোটাও অকল্পনীয়; বিবাহিত নারীদের স্বামী-সন্তানেরা তো এদিন বাসায় থাকে, জীবন তো সেদিন এমনিতেই ভরপুর। আর রবিবার মানেই তো কেউ নিয়ম করে গির্জায় যাবে, আত্মীয়দের বাড়ি যাবে, নয়তো বাড়িতে থেকেই অবিচ্ছেদ্য শান্তি আর নিস্তব্ধতার মাঝে ছুটির আমেজ উপভোগ করবে।
সে সময় ইউরোপে নাম-দিবস পালন করা হতো (এটি ছিল এখনকার সময়ের জন্মদিন পালনের মতো। আসলে জন্মদিন পালনের প্রচলন নাম-দিবস পালনের একটি বিবর্তিত ধারা)। ক্যাথলিক ধর্মের সাধু-সন্তদের সঙ্গে মিলিয়ে সন্তানদের নাম রাখা হতো। তো বছরে নিজের নামের সঙ্গে মেলানো সেই সাধু-সন্তদের যেদিন জন্মদিন থাকত সেদিন তারা নিজেদের জন্য নাম-দিবস পালন করত কফির দাওয়াতের উপলক্ষ হিসেবে নাম-দিবস ছিল সর্বাগ্রে, অবশ্য কেউ কেউ বাচ্চাদের প্রথম দাঁত পড়ল বা প্রথম হাঁটতে শিখল এটিকেও উপলক্ষ হিসেবে ধরতেন। আবার যাদের আমেরিকা থেকে টাকা আসত তারা সেটিকেই অজুহাত ধরে প্রতিবেশীদের দাওয়াত করতেন। এর সঙ্গে অবশ্য কাঁথা সেলাই আর তাঁত বোনার দাওয়াতও থাকত। তারপরও দেখা যেত যতগুলো অনুষ্ঠান করার কথা ততগুলো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এক বছর পর দেখা গেল এক মহিলা তার বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। সেবার তার দাওয়াত দেওয়ার পালা ছিল, এতে তার কোনো আপত্তিও ছিল না; কিন্তু তিনি কোনোভাবেই উদযাপন করার উপলক্ষ হিসেবে কোনো দিনক্ষণ ঠিক করতে পারছিলেন না। যেহেতু তার বেদা নামটি কোনো ধর্মীয় পঞ্জিকা অনুসারে রাখা হয়নি তাই তার কোনো নাম-দিবস ছিল না। তার সব আত্মীয়স্বজন সমাধিক্ষেত্রে ঘুমাচ্ছে, তাই দাওয়াত দেওয়ার জন্য তারাও কোনো উপলক্ষ হতে পারে না। তিনি এতটাই বৃদ্ধা যে তার কাঁথার বয়স তাকে ছাড়িয়ে যাবে। তার একটি প্রিয় বিড়াল আছে। সত্যি বলতে কি এই বিড়ালটি তার মতোই কফি পান করে; কিন্তু এই বিড়ালটিকে উপলক্ষ করে দাওয়াতের আয়োজন করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
নিজের জন্ম-পঞ্জিকাটি তন্ন তন্ন করে খুঁজে তিনি এর একটি সমাধান বের করতে চেয়েছিলেন। তিনি পড়তে শুরু করেন রাজযোগ আর রাশিচক্র থেকে, এরপর পড়তে পড়তে বাজার আর ১৯১২ সালের ডাক বিভাগ পর্যন্ত পৌঁছান; কিন্তু কোনোই উপযুক্ত উপলক্ষ আর খুঁজে পান না। সাতবারের মতো বইটি পড়ার পর ‘গ্রহণা’ শব্দটিতে এসে তার চোখ আটকে যায়। তিনি খেয়াল করলেন যে সে বছর, মানে ১৯১২ সালে, সতেরোই এপ্রিল সূর্য গ্রহণ হওয়ার কথা। এটি সংগঠিত হবে অপরাহ্ণ বেলা ১২:২০ থেকে ২:৪০ পর্যন্ত। এ সময় সূর্যের আয়তনের নয়-দশমাংশ ঢেকে যাবে। গ্রহণের কথা বেদা আগেও অনেকবার পড়লেও তেমন গুরুত্ব দেননি; কিন্তু এটি এখন তার কাছে অন্ধকার গুহার শেষে আলোর ঝলকানি।
‘এবার আমি পেয়ে গেছি!’ তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
কিন্তু পর মুহূর্তেই কিছুটা দমে গিয়ে বেদা ভাবনাটিকে ঝেড়ে ফেলতে চান। এটি শুনলে অন্য নারীকুল নিশ্চয় তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।
যদিও এর পরের কয়েক দিন না চাইলেও যখন তিনি পঞ্জিকা নিয়ে বসতেন তখন এই ভাবনাটি তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে এর থেকে আর কোনো ভালো বিকল্প হতে পারে না। তার এসব বান্ধবীকে কি তিনি সূর্যের থেকেও বেশি ভালোবাসেন? পুরো শীতে তার বাড়িতে কোনো সূর্যের আলো পড়ে না। তিনি দিন গুনতে থাকেন কবে আবার বসন্তে সূর্যের দেখা পাবেন। একমাত্র সূর্যই তার প্রতি সবসময় সদয় আর বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল যদিও সহজে তার দেখা মেলে না, তারপরও তার সব প্রতীক্ষা সূর্যের জন্য। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো তার স্মৃতি কাঁপিয়ে দিল। তার হাত যেন ক্রমশ অবশ হয়ে এলো এবং তখন তিনি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখলেন, কত বিবর্ণ আর ফ্যাকাশে, মনে হচ্ছিল কেউ যেন তাকে ব্লিচ দিয়ে ধুয়েছে। শুধু সূর্যরশ্মির শক্তিশালী উত্তাপের নিচে দাঁড়ালে তার মনে হয় জিয়নকাঠির পরশে তার জীবন্মৃত দেহটির মধ্যে অফুরন্ত প্রাণের ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছে। উদযাপন করার জন্য সারা বছরে গ্রহণার থেকে আর কোন দিনটি বেশি উপযুক্ত হতে পারে? এদিন পরম বন্ধু সূর্য অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তার বিজয় ছিনিয়ে আনে, বিকশিত হয় আরও মহিমান্বিত আলোকচ্ছটায়।
বেদা হিসেব করে দেখল সতেরো এপ্রিল খুব একটা বেশি দূরে নয়, তবে একটি দাওয়াত আয়োজন করার মতো হাতে যথেষ্ট সময় আছে। সুতরাং সূর্যগ্রহণের দিন স্টিনা, লিনা, কাজসা, মাজা এবং অন্যান্য মহিলা ফিন-ডার্কনেসে বেদার সঙ্গে বসে কফির আড্ডায় মেতে উঠলেন। যা যা কল্পনা করা যেতে পারে তার সবই আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল, আর কফির পেয়ালাও ওঠানামা করছিল দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের মতো। অভ্যাগত অতিথিগণ অবশ্য হাজার চেষ্টা করেও বেদার এই দাওয়াতের পেছনের উপলক্ষটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
ইতোমধ্যে সূর্যগ্রহণ তার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। অবশ্য এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিল না। কেবল এক মুহূর্তের জন্য, যখন আকাশ ধূসর বর্ণ ধারণ করে চারপাশ অন্ধকার করে ফেলল তখন সমগ্র প্রকৃতি যেন রূপান্তর হয়ে গেল একটি অসাড় গারদখানায়, এবং প্রবল বাতাসের চিৎকার কেয়ামতের শিঙা আর শেষ বিচারের দিনের হাহাকারের কথা মনে করিয়ে দিলজ্জকেবলমাত্র তখনই তারা কিছুক্ষণ থামলেন এবং আতঙ্কিত বোধ করলেন। বাস্তবে তাদের সামনে ধূমায়িত কাপের কফি ছিল, এবং তারা আবার আগের খোশমেজাজে ফিরে আসলেন।
অবশেষে যখন সব শেষ হয়ে গেল, এবং সূর্য যখন আবার তার পুরনো স্বর্গে ফিরে আসলো আরও উজ্জ্বল, আরও হাস্যোজ্জ্বল হয়েজ্জতখন মনে হচ্ছিল সারা বছর এরকম সূর্যরশ্মির শক্তিমত্তা এর আগে কেউ আর কখনো দেখেননি। প্রবীণ বেদা তখন জানালার কাছে পৌঁছে গেছেন। হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালেন। বাইরের সূর্যস্নাত ঢালের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে গাইতে শুরু করলেন,
‘তোমার জ্বলন্ত শিখা আবার উপরে উঠল,
আমার অভিবাদন নাও হে আমার পালনকর্তা!
এ প্রাণে নব সঞ্চারিত সাহস, শক্তি, আর আশায় উজ্জীবিত হয়ে,
আমি গেয়ে চলি জীবনের গান।’
শীর্ণকায় আর স্বচ্ছ জানালার আলোর মাঝে ক্ষীণ কিন্তু ঋজু অবয়বে দাঁড়িয়ে বেদা যখন গান গাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল সূর্যরশ্মিরা যেন তাকে ঘিরে নাচছে, যেন তারা তাকে তাদের জীবন, শক্তি আর উজ্জ্বলতার কিছু দিতে চায়। যখন তার স্তবগান শেষ হলো তখন তিনি মুখ ফিরালেন তার অতিথিদের দিকে, অনেকটা ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে।
‘দেখ’, তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘সূর্যের থেকে আমার আর কোনো ভালো বন্ধু নেই, তাই তার গ্রহণের দিনটিকে আমি উদযাপন করতে চাইছিলাম। আমার মনে হয়েছে যখন সে তার রাহুগ্রাস কাটিয়ে উঠতে পারবে তখন আমাদের সবার উচিত তাকে অভিবাদন জানানো।’
প্রবীণ বেদার অনুভূতি তাদের হৃদয়কেও স্পর্শ করল। তারাও তখন সূর্যের বন্দনা শুরু করলেন। ‘ধনী এবং গরিব সবার জন্যই সূর্য একই রকম, যখন সে শীতের দিনে কুঁড়েঘরে উঁকি দেয়, তখন তা উনুনের উত্তাপের মতোই স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক। শুধু তার হাসিখুশি মুখটি দেখার জন্যই বেঁচে থাকাটাকে সার্থক বলে মনে হয়, তা জীবনে যত কষ্টই আসুক না কেন।’
একসময় অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়, সুখী আর পরিতৃপ্ত হয়ে নারীকুল যে যার ঘরে ফিরে আসে। সূর্যের মতো একজন ভালো আর বিশ্বস্ত বন্ধুর সন্ধান পেয়ে তারা একরকমভাবে আগের থেকে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ আর নিরাপদ বোধ করছিলেন।