শিক্ষার লক্ষ্য এবং পদ্ধতিগত চিন্তার প্রয়োজনীয়তা

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:১০ পিএম | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৩ পিএম

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

‘কোনো কিছুই ভালো বা মন্দ নয়, চিন্তাই সেটিকে কোনো একটি আদল দেয়।’ - উইলিয়াম শেক্সপিয়ার 

শিক্ষার লক্ষ্য কী হওয়া উচিত তা নিয়ে নানাজন নানাভাবে ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। সেসব বক্তব্যের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা যেতে পারে, আবার নাও পারে। শিক্ষার লক্ষ্য সামগ্রিকভাবে কী হওয়া উচিত তার একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণ এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এখানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়। 

এক

বস্তুজগতে টিকে থাকার জন্য শিক্ষার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। তবে অবশ্যই তা হতে হবে সুশিক্ষা। বহুকাল আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে সেই অতি শক্তিশালী অস্ত্র, যা দিয়ে তুমি পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারো।’

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনটি; ক) আদতেই কি শিক্ষামাত্রই জগৎকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করতে পারে? খ) সুশিক্ষাই বা কী? 

গ) সব ধরনের শিক্ষাই কি সুশিক্ষা এবং আমাদের মনোজগতের বিকাশ ঘটায়? 

তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে শুরু করি। যদি বলি সব শিক্ষাই সুশিক্ষা, তবে কেন আমরা বলি, আমাদের পাঠ্যক্রম মান্ধাতার আমলের, একে নবায়ন ও আধুনিক করা উচিত এবং তা বাস্তব দুনিয়ার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা যুগোপযোগী করে?

বাংলাদেশের কথাই ধরুন। এই দেশের ৯০.৪% লোক মুসলমান হওয়ার পরও কেন শিক্ষিত ও বিত্তবান জনগোষ্ঠী তাদের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠাতে কম আগ্রহ প্রকাশ করেন? উত্তরটা সহজ-মানুষ চায় আধুনিক জ্ঞান ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা; যা দিয়ে মানুষ ভালোভাবে যেমন জীবিকা নির্বাহ করবে, সেই সঙ্গে তার চিত্তের বিকাশও ঘটাতে পারবে। আমি বলব না যে, মাদ্রাসা শিক্ষা বাস্তবসম্মত শিক্ষা নয়। মাদ্রাসা শিক্ষাকেও যুগোপযোগী করা যায় এবং সেইসঙ্গে চাকরির বাজারের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়, সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি।

দুই

আমরা বলছিলাম সুশিক্ষা এবং যুগোপযোগী শিক্ষার কথা। বুঝতে হবে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে সুশিক্ষিত মানুষদের দ্বারা, যারা মানুষের প্রকৃত ও বাস্তবসম্মত চাহিদা বোঝেন। আর তারা চেষ্টা করেন যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোও যাতে তাদের মতোই বোধসম্পন্ন হয় এবং যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। সেটি তখনই সম্ভব, যদি শিক্ষা মানুষকে সঠিকভাবে চিন্তা করতে শেখায়। মনে রাখতে হবে যে, মানব সভ্যতার বিকাশ হচ্ছে মানুষের পদ্ধতিগত চিন্তার বিকাশ। পদ্ধতিগত চিন্তার কথা বললাম এই অর্থে যে, মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল; কিন্তু সব মানুষই জগতে ইতিবাচক কাজ করতে ও ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। সুচিন্তিত ও পদ্ধতিগত শিক্ষা মানুষকে পদ্ধতিগত ও বাস্তবসম্মত চিন্তা করতে পথ দেখায়। যেমন একদা পদ্ধতিগত ও বাস্তবসম্মত চিন্তা বাস্তবসম্মত শিক্ষার রূপরেখা তৈরি করেছিল। মার্কিন অর্থনীতিবিদ টমাস সোয়েল একটা মজার উদাহরণ দিয়েছেন, ‘জনি পড়তে পারে না এটি কোনো সমস্যা নয়, জনি চিন্তা করতে পারে না, সেটিও সমস্যা নয়। সমস্যা হলো জনি জানে না যে, চিন্তা আদতে কী। সে মনে করে যে, যা আমি উপলব্ধি করলাম তা-ই চিন্তা।’

টমাস সোয়েল আদতে পদ্ধতিগত চিন্তার কথাই বলেছেন; কারণ আবোল-তাবোল ভাবনা মাত্রই পদ্ধতিগত চিন্তা নয়, আর তা মানুষ বা জগৎকে কিছু দিতে সক্ষমও নয়। পদ্ধতিগত চিন্তা আদতে যুক্তির নিরিখে সব ধরনের সমস্যাকে বাস্তবসম্মতভাবে বোঝার ও উপলব্ধি করার ও সেই সঙ্গে সেগুলোর সমাধানের বা উত্তরণের বাস্তবিক পদ্ধতি ও কাঠামো নির্মাণের অনুধ্যান ও মনোজাগতিক প্রকল্প। পরে তা কাগজে-কলমে প্রতিভাত হয় ও সুবিন্যস্তভাবে কলাকৌশলে রূপান্তর হয়।

তিন

উড়োজাহাজ আবিষ্কারকালে অরভিল ও উইলবার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় নিশ্চয়ই অবাস্তব কোনো চিন্তা করেননি। তাদের যান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল সম্পর্কে ভালোমতো জানতে ও যথার্থভাবে সেগুলো আত্মস্থ এবং তার ওপর ভিত্তি করে আরও বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাতে হয়েছে। তাতে অবশ্যই তারা কোনো আকাশ-কুসুম ও অবাস্তব চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন না। এসব হলো পদ্ধতিগত চিন্তার উদাহরণ। 

আমি ধর্মের বিপক্ষে নই। ঈশ্বরকে বাতিল করার সিদ্ধান্তে আসার মতো জ্ঞানমার্গে এখনো মানব-জাতি পৌঁছেনি। বিশ্বের ধর্মগুলো যেমন-হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলামসহ আরও যেসব ধর্ম আছে সেগুলো মানবজাতির উন্নয়নের জন্য অনেক সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছে। যখন ইউরোপ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, ইসলাম সেই সময় বিশ্বকে আলোকিত করেছিল; যে কথা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব অধ্যাপক জ্যাক গুডি তার বিখ্যাত বই ‘দ্য থেপ্ট অব হিস্ট্রি’তে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ইউরোপে রেনেসাঁর আবির্ভাবেরও মূল কারণ ছিল মুসলমানদের জ্ঞান। কিন্তু মুসলমান জাতির পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ, পরবর্তীকালে আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে তাদের নিজেদের সম্পৃক্ত করতে না পারা। ঔপনিবেশিক রদ্দি মার্কা সিলেবাস নিয়ে মাদ্রাসাগুলো এখনো চলে। যে শিক্ষা-ব্যবস্থা মানুষকে মুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখায় না তা মৃত শিক্ষা-ব্যবস্থা। ইসলামের মূল বিশ্বাসকে অপনোদন না করেও এবং পবিত্র কোরআনকে আমাদের জীবনে লালন করেও কি মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থা হাল-নাগাদ করা যায় না? আমার তো মনে হয় তা সম্ভব। আসুন বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করি।

চার

মাদ্রাসাগুলোতে কোরআন-হাদিস পড়ানো হয়। ছাত্ররা কোরআন-হাদিস মুখস্থ করেন, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু অনেকে তা করেন আরবি ভাষা ভালোমত আত্মস্থ না করেই। এই কোরআন-হাদিসের আরবি জানার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আধুনিক, বিশেষত আরব দুনিয়ার আঞ্চলিক আরবিও জানা উচিত। এতে একদিকে তারা যেমন আরবিভাষী দূতাবাসগুলোতে ভালো চাকরি পাবেন, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যসহ সব আরবিভাষী দেশগলোতে ব্যবস্থাপকের কাজসহ উচ্চ আয়ের ও সম্মানজনক পদগুলোতে নিজেদের দাখিল করতে পারবেন। 

বাংলাদেশের প্রচুর লোক মধ্যপ্রাচ্যসহ সব আরবিভাষী দেশগুলোতে কাজ করেন। কিন্তু তারা নিম্ন আয়ের ও নিম্নপদের চাকর-ঝিয়ের কাজগুলো করে থাকেন। আমাদের দেশের অর্থনীতি কিন্তু এই আরবিভাষী দেশগুলো থেকে আসা অর্থ বা রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। তা হলে এই বিষয়ে কেন আমরা আজও জোর দিচ্ছি না? এই বিষয়ে আমাদের সুপরিকল্পিত স্কিম হাতে নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত আধুনিক আরবি ভাষা শেখার জন্য প্রচুর প্রতিষ্ঠান খোলা এবং মাদ্রাসাগুলোরও উচিত এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া, যাতে আমরা ওসব দেশের উচ্চ আয়ের ও সম্মানজনক পদগুলো পেতেও সবলভাবে নামতে পারি প্রতিযোগিতায়। 

সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষাতেও আমাদের দক্ষতা আরও বাড়ানো উচিত। আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করার মতো ইংরেজি আমরা কজন জানি? জ্ঞানের এই প্রায়োগিক সাফল্য নির্ভর করছে আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ওপর, যার জন্য আমাদের পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। 

পাঁচ

গ্রিসদেশে যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও ৫০০ বছর আগে এক আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল; কারণ গ্রিকরা পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করতে শিখেছিল। সক্রেটিস এই সভ্যতার চিন্তাধারাকে আরও বেগবান করে তোলেন, তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রশ্নের মাধ্যমে যুক্তি ও তর্কের ভেতর দিয়ে সত্যে আরোহণের পথকে অবারিত করে। এর মাধ্যমে তিনি কী ভালো, কী ন্যায়পরায়ণতা-সেসব বিষয়ে তার নিজস্ব সিদ্ধান্তে আরোহণ করতে চেয়েছেন এবং সেই সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত যে হতে হবে যৌক্তিক বিচারে সর্বজন গ্রাহ্য-সেদিকেও নজর দিয়েছেন। এ সবকিছুই হয়েছে তার চিন্তার পদ্ধতি নির্ধারণের মাধ্যমে; ফলে চিন্তার ইতিহাসে তিনি পেয়েছেন অমরত্ব। আধুনিক গণিত, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র সবই পদ্ধতিগত চিন্তার ফসল। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘গতকালের কাছ থেকে শেখো, আজকের জন্য বাঁচো, আর আশা করো আগামীকালের জন্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশ্ন করা বন্ধ কোরো না।’

এই প্রশ্ন করার মাধ্যমেই মানুষ চিন্তার জগতে উপস্থিত থাকে এবং পদ্ধতিগতভাবে তার উদ্ভাবনীশক্তির বিকাশ ও প্রকাশ ঘটায়; তা সেই প্রশ্ন অপরকে করা হোক কিংবা নিজেকে।

ছয়

মানব-জাতির ইতিহাস বহু পুরনো, কিন্তু মানব-সভ্যতার ইতিহাস সেই তুলনায় নতুন। এর কারণ মানুষ পদ্ধতিগতভাবে চিন্তা করতে শিখেছে অনেক পরে। কয়েক মিলিয়ন বছরের পুরনো মানুষের সন্ধান নৃবিজ্ঞানী ও প্রত্নতত্ত্বিকগণ পেয়েছেন; অথচ মানব-সভ্যতা ৮ থেকে ১০ হাজার বছরের বেশি নয়। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মেসোপটেমীয় সভ্যতাগুলো অর্থাৎ ফিনিশীয়, ব্যাবিলনীয়, ক্যালডীয়, আসেরীয় ইত্যাদি সভ্যতার কথাই বলছি। এর কারণ মানুষের পদ্ধতিগতভাবে চিন্তার ইতিহাস আদতেই নবীন। পদ্ধতিগত চিন্তার সূচনার ফলে মানুষ মিলিয়ন মিলিয়ন বছরে যা করতে পারেনি, গত পাঁচ হাজার বছরে তা সে করতে পেরেছে। ফলে পদ্ধতিগত চিন্তার বিকাশ যাতে ঘটে তার ওপর কাজ করাই আদতে আধুনিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষার বাদবাকি সব সাফল্য এর ওপরই নির্ভরশীল।

লেখক: গবেষক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh