শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

বাবুল চন্দ্র সূত্রধর

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৪ পিএম

প্রচ্ছদ: সাম্প্রতিক দেশকাল

প্রচ্ছদ: সাম্প্রতিক দেশকাল

সম্প্রতি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক, পুলিশ, আইন প্রণেতাবিচারক প্রভৃতি নানারূপে আবির্ভুত হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটির অবতারণা। সংশ্লিষ্ট উর্ধতন মহল থেকে কার্যকর কোন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না বলেই এহেন প্রবণতা থামছে না; যেসব শিক্ষার্থী এসব অকালপক্ক অযাচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের নিকট থেকেও কোন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আমার নজরে পড়েনি। পড়বেই বা কেন, এখন কি আর বাদশাহ আলমগীরের যুগ আছে? বর্ণিত বিশেষণগুলো শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপ হওয়াটা লজ্জাজনক। আমার সত্যিই অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে এই বিশেষণগুলোর ব্যবহারে। আমিও সামান্য লেখাপড়া করেছি বিধায় এক সময় ছাত্র ছিলাম। শিক্ষাজীবন সম্পন্ন হয়েছে তিন দশক আগে।

চলমান ঘটনাবলীর চরিত্র প্রকৃতি দেখে পেছন ফিরে তাকাই আমার শিক্ষকদের মুখচ্ছবির দিকে। চার স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নকালে প্রত্যক্ষ শিক্ষক ছিলেন ষাট জনের মত। প্রায় সমান সংখ্যক পরোক্ষ শিক্ষকও ছিলেন। আর পাশাপাশি অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের/ বিভাগের শিক্ষকদেরকেও আমরা শিক্ষক বলে জানতাম এবং নিজেদের শিক্ষকের মতই সম্মান করতাম। সব মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক বলা যায়।

ছাত্রজীবনে এবং ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর আমাদের কোন কোন শিক্ষক সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য শুনেছি, আমরা সেগুলোকে বিশ্বাসেও আনতে চাইনি, আলোচনায়ও নিয়ে আসতে চাইনি। আমাদের সহজ সরল উপলব্ধি ছিল- এসব আমাদের বিষয় নয়। কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালে একবার স্বচক্ষে দেখলাম, দুটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন মুখোমুখি হয়েছে, হাতাহাতি ধস্তাধস্তি শুরু হয় হয় ভাব, এমন সময় অধ্যক্ষ মহোদয়কে আসতে দেখে দু’দল দু’দিকে কেটে পড়ে।

আমাদের প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যুগটি ছিল বেত/ কঞ্চির যুগ। তখন যে শিক্ষক এগুলোর ব্যবহার বেশী করতেন তাদেরকেগরম স্যারবলা হত। কোন কোন স্যার বেত বা কঞ্চির অপেক্ষা করতেন না, তারা ব্যবহার করতেন হাত- চড়. থাপ্পড়, কিল, ঘুষি চালাতেন সমানে। আবার দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু ভেঙ্গে বসিয়ে রাখা অথবা কান ধরে উঠ-বস করানোর মত ব্যবস্থাও ছিল। কোন কোন শিক্ষকের শাস্তির আগ্রহ অধিক ছিল পড়াশোনা ভালভাবে শেষ না করতে পারার জন্য আবার কারো কারো অধিক আগ্রহ ছিল দুষ্টুমির ক্ষেত্রে।

আর, হেডমাস্টার মানেই ছিল এক ভীতিকর শব্দ। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন শ্রেণীকক্ষে শাস্তির ঘটনা ঘটত। স্যারের বেত্রাঘাতে রক্তপাত এমনকি মাথা ফেটে যাওয়ার মত ঘটনাও তখন ঘটেছে। তবে কোন দিন কোন অভিভাবককে স্কুলে অভিযোগ নিয়ে আসতে দেখিনি।

শিক্ষক পিতৃতুল্য গুরুজন সেটি না হয় বাদ দিলাম, অন্তত শ্রদ্ধেয়জন তো। একজন শিক্ষক মানুষ, তার ভুল-ত্রুটি থাকবে, সীমাবদ্ধতা থাকবে, এটি অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার বিচারের দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের হাতে আসার কথা নয়। এরা বড়জোর পোষ্টারিং, দেয়াল লিখন, গণচিঠিঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ, কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রতিকার, সুবিচার বা তদন্ত প্রভৃতি দাবি করতে পারে।

সর্বোপরি, সকল ধরনের অপরাধের বিচারের জন্য দেশে আইন রয়েছে, সংবিধান রয়েছে. যা রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকলেই মেনে চলতে বাধ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ধারণকৃত আচরণ বক্তব্যগুলো তুলে ধরাটাকে বিবেকবর্জিত বলে আমার মনে হয়েছে। এসব ঘটনার কোন বিশেষণও আমি খুঁজে পাই না। এসব ছাত্রছাত্রীদের পেছনে কোন সাংগঠনিক ইন্ধন বা যোগসাজস রয়েছে আমার তা মনে হয় না। আমার পরিচিত বন্ধুস্থানীয় বেশ জন শিক্ষক বলেছেন যে, ছাত্রনেতারা তাদেরকে এসে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন এবং কোনো সমস্যা হলে যেন তাদেরকে জানানো হয়, সেজন্য ফোন নাম্বার দিয়ে গেছেন। অবশ্য দেশের বিভিন্ন স্থানের স্তরের এসব শিক্ষকের কণ্ঠে লক্ষ্য করেছি এক ভীত-সন্ত্রস্ত ধ্বনি। আমার ব্যক্তিগত একটি ধারণা রয়েছে বিষয়ে; তা হল, সারাদেশে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কতিপয় শিক্ষকের সাথে যে আচরণ করে চলেছে ধারাবাহিকভাবে, তা সম্পূর্ণ তাদের আপন চিন্তাপ্রসূত নয়। স্বার্থান্বেষী কারো না কারো অনুপ্রেরণা রয়েছে পেছন থেকে।

আমার এই ধারণার সমর্থনে যুক্তিটি হলো- প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এরা শিক্ষকদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করতে উদ্যত হয়েছে, যেখানে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরছে না; তারা বিচারও চাচ্ছে না, সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে কথা বলার বা আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগটুকুও দিচ্ছে না; একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে তারা শিক্ষকের দস্তগত আনতে ধস্তাধস্তি করছে। একজন ছাত্র তো শিক্ষককে মারতে পেরেছে বলে উল্লাসের আতিশয্যে কথাই বলতে পারছিল না! আবার একই সাথে শিক্ষকের প্রতি ছাত্রসুলভ আচরণের ঘটনাও ঘটেছে যদিও এর পরিমাণ উল্লেখ করার মত নয় আমার যুক্তির আরোও সমর্থন যুগিয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক। ৩১ আগস্ট, ২০২৪ ইং তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পত্রিকাটি জানিয়েছে, নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি এক জরুরী বৈঠকে উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের ৭৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা প্রদান করেছেন। কারণ হিসেবে সমিতির সভাপতি গোলাম আজম বলেছেন, ‘‘কিছু অসাধু চক্র স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ফুঁসলিয়ে ব্যবহার করে উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ওপর অন্যায়, অবৈধভাবে নির্যাতন, অপমান, হেনস্তা এবং জোরপূর্বক পদত্যাগের চেষ্টা করছেন।

এর ফলে গত ২৭ আগস্ট আমরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ স্মারকলিপি প্রদান করেও কোন প্রতিকার না পেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।বলা আবশ্যক যে, ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওযার ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয়, জাতি এগুলো দেখে দেখে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের নিকট আমার কিছু প্রস্তাব রয়েছে। শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া মান, ছাত্রদের প্রতি যথাযথ দাযিত্ব পালন, ছাত্রদের সাথে যৌক্তিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, মেধার সুষ্টু মূল্যায়ন, নীতি-নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রভৃতি নানা বিষয়ে কিছু কিছু শিক্ষকের আচার-আচরণ বা কৃতকর্ম মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যা দেখে চরম লজ্জা পেতে হয়। সর্বজন-শ্রদ্ধেয় এই পদ-পদবীর দায়িত্ব সম্মানের বিষয়টি নিয়ে আপনারা নিজেরা একটু বসাবসি করেন না? প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিও তো রয়েছে; সরকারেরও অনেক বিভাগ/ উপবিভাগ রয়েছে।

শিক্ষার্থী শিক্ষকের সম্পর্ক গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এক বিরাট প্রভাব রাখে, যা সৎ, সুস্থ, সুন্দর সুদক্ষ জাতি গঠনের মৌল পূর্বশর্ত। তাই প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, শিক্ষকতা পেশাটিকে জাতীয়ভাবে একটু ভিন্ন মাত্রায় বিবেচনা করা প্রয়োজন।

শিক্ষকতাকে নিছক একটি চাকুরী বা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে না দেখে কিভাবে একটি অত্যাবশ্যকীয় জাতীয় দায়িত্বের পর্যায়ে উন্নীত করা যেতে পারে, সে বিষয়ে নীতি নির্ধারণী স্তরে বিশেষ ভাবনা আজ সময়ের দাবী। শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি নিয়েও ভাবার অবকাশ রয়েছে বলে মনে হয়।

শিক্ষার্থীদের প্রতিও এহেন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত হওয়ার জন্য অনুরোধ করব। শিক্ষার্থীদের সামনে সম্ভাবনার অপার সুযোগ, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আগামীতে তারাই নেতৃত্ব দেবে; তাদের কেউ কেউ শিক্ষকও হবে। আইন বা বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়া পরিণামে কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। আমি সমকালীন স্বনামধন্য পণ্ডিত পি জে আব্দুল কালাম-এর একটি অতি মূল্যবান কথা দিয়ে লেখাটির ইতি টানবো: ‘‘একজন খারাপ ছাত্র একজন দক্ষ শিক্ষকের নিকট থেকে যা শিখতে পারে, তার চেয়ে একজন ভাল ছাত্র একজন খারাপ শিক্ষকের নিকট থেকে অনেক বেশী শিখতে পারে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh