আরিফ মজুমদার
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম
প্রতীকী ছবি।
মায়াবী চোখের মেয়েটিকে খুনের উদগ্র ইচ্ছে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করছে বিপদগামী যুবক মোসাদ্দেক। ছয় শ’ পঞ্চাশ টাকায় পশু জবাইয়ের কাজে উপযোগী একটি ধারালো ছুরিও সে বানিয়ে নেয়, স্থানীয় বাজারের দক্ষ কামার সুনীল শীলের দোকান থেকে। ধারালো ছুরি হাতে পেয়েই খুনের কাজটি সারতে কেমন অস্থির হয়ে পড়ে মোসাদ্দেক! খুব তাড়াতাড়িই সে খুন করতে চাইছে কলেজপড়ুয়া ইবা মেয়েটিকে! প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদপ্রায় মোসাদ্দেক সারাক্ষণ ডুবে আছে খুনের তাড়নায়! রাতের ঘুমে খুনের দৃশ্যও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ধরা পড়ছে তার বিকৃত মস্তিষ্কে! শুধু সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে যেন। অবশেষে সুযোগ পেয়েও যায় সে। ধারালো ছুরিটি হাতে আসার তিন দিনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় ইবার ঘরে ঢুকে গেল মোসাদ্দেক। পাঞ্জাবির নিচে কোমরে লুকিয়ে রাখা ধারালো ছুরি বের করে ইবাকে এলোপাথাড়ি কোপাতে কোপাতে বকতে থাকে মোসাদ্দেক,‘তোর নতুন ভাতার লাগবে! আমারে পছন্দ হইতাছে না...।’
মুহূর্তের মধ্যে অনবরত ধারালো নির্দয় ছুরির আঘাতে,‘ও-মাগো, ও-মাগো..., তীব্র গলায় চিৎকার করতে থাকে ইবা। সকিনা ও তার অন্য দুই মেয়ে ছুটে আসে ইবার চিৎকারে। ইবাকে বাঁচাতে এগুলে ধারালো ছুরি দিয়ে তাদেরও এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মোসাদ্দেক। তখন ইবার বাবা সজল গাজী ঘরে ছিলেন না। মা-মেয়েদের কান্নাকাটির শব্দে তাদের উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল বাড়ির লোকজন। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত অবস্থায় পেল ইবাকে। আর মুমূর্য অবস্থায় সকিনা ও তার ছোট দুই মেয়েকে রেফার্ড করা হলো ঢাকা মেডিকেলে। সদর হাসপাতালের ট্রলিতে রক্তাক্ত ইবার নিথর চোখ দুটোয় তখনো ঝরছিল ভীষণ মায়া! অসম্ভব সুন্দর চেহারা ইবার মুখখানি গোলগাল আর মাথাভর্তি কালো চুল। ইবার দিকে একবার কারো চোখ পড়লে সেই চোখ ফেরানো মুশকিলই বটে! বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় তাকে ধারালো ছুরি দিয়ে নির্দয় হাতে কুপিয়ে খুন করল মোসাদ্দেক। ইবার বাবা সজল গাজী চাঁদপুর সদর থানাধীন এলাকায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন। তাদের তিন মেয়ে।
সজল গাজীর বড় মেয়ে ইবা। বয়স একুশ। ইবার বোন টিয়ার বয়স সতের আর টুনটুনির তের। ইবা জেলা সদরের সরকারি কলেজটি থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেছে। তারপর ওই কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল ইবা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সজল গাজীর ছোট মেয়ে টুনটুনিকে ঘরে এসে আরবি পড়াত বাড়ির পাশের মসজিদের ইমাম মোসাদ্দেক। চট্টগ্রামের একটি কওমি মাদ্রাসা থেকে মোসাদ্দেক দাওরায়ে হাদিস শেষ করে। এখানে মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি শিক্ষকতা করে একটি কওমি মাদ্রাসায়। সকাল-সন্ধ্যায় আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ি গিয়ে গিয়ে প্রাইভেট আরবি পড়াত সে। টুনটুনিকে আরবি পড়াতে এসে ইবার দিকে নজর পড়ে মোসাদ্দেকের। নানা রকম ছলচাতুরি করে ইবাকে মৌখিকভাবে প্রতারণামূলক বিয়েও করে মোসাদ্দেক! পরে বিয়ের বিষয়টিকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইবার পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে সে। মোসাদ্দেকের ধোঁকাবাজি বুঝতে পেরে তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ইবার পরিবার। তাকে ঘরে এসে আরবি পড়ানোর জন্যও নিষেধ করেন সজল গাজী। তারপরও ইবাকে বিয়ের জন্য সে নানাভাবে প্রস্তাব পাঠায়। ইবার পরিবার বারবার তার বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এতে রাগে-অপমানে ক্ষিপ্ত হয়ে ইবাকে রাস্তায় একা পেলেই উত্ত্যক্ত করে মোসাদ্দেক। এভাবে ইবাকে দীর্ঘদিন উত্ত্যক্ত করতে থাকায় বাধ্য হয়েই থানায় অভিযোগ করেন সজল গাজী। পুলিশি হস্তক্ষেপে কিছুদিন উত্ত্যক্ত করা থেকে বিরত থাকে মোসাদ্দেক। ইবাও দ্রুত স্টুডেন্ট ভিসায় ইউরোপে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাশাপাশি স্থানীয় একটি অনলাইন শপেও পার্টটাইম জব করছিল সে। উচ্চশিক্ষার জন্য স্টুডেন্ট ভিসায় ইউরোপে যাওয়ার প্রস্তুতির খবরে ফের ইবাকে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে মোসাদ্দেক। কিন্তু ইবার পরিবারকে কোনোভাবেই সে রাজি করাতে পারছিল না। অগত্যা, বাড়ির বাইরে আসা-যাওয়ার পথে ইবাকে ফের উত্ত্যক্তের পাশাপাশি প্রাণনাশের হুমকিও দিতে থাকে মোসাদ্দেক। ইবা বিষয়টি তার বাবা-মাকে বলে দেয়। নিরুপায় হয়ে ফের থানা পুলিশকে জানালো সজল গাজী। মোসাদ্দেককে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। কদিন পর জামিনে বেরিয়ে মানসিকভাবে চরম বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে গেল মোসাদ্দেক! তারপর কেমন নির্দয় ভাবে সে খুন করল ইবাকে...! মোসাদ্দেককে একমাত্র আসামি করে ইবাকে খুন আর পরিবারের অন্যান্যদের হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা করল সজল গাজী।
এদিকে ইবাকে খুনের পর থেকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়ার চেষ্টায় নিজের চেহারায় পরিবর্তন এনে এক বন্ধুর বাসায় থেকে আত্মগোপন করে মোসাদ্দেক। কিন্তু তাতে বেশি দিন সুযোগ পায়নি সে, এক রাতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলো মোসাদ্দেক। আদালতে ইবাকে খুনের অপরাধ স্বীকার করে নেয় মোসাদ্দেক। সাক্ষী-প্রমাণেরও তেমন দরকার পড়ল না। কিন্তু মোসাদ্দেক কোনোভাবেই স্বীকার করল না, কেন সে এরকম নির্দয়ভাবে খুন করল ইবাকে? অবশ্য আসামিপক্ষের উকিল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে- আসামি মানসিক বিকারগ্রস্ত, উন্মাদ...। কিন্তু প্রমাণে বিষয়টি টেকেনি, ডাক্তারের রিপোর্টে মোসাদ্দেকের মস্তিষ্ক বিকৃতি মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হলো। তদপুরি আদালতে প্রমাণিতও হলো যে, আসামি দুশ্চরিত্র, লম্পট, নিষ্ঠুর প্রকৃতির যুবক এবং নির্দয় খুনি! কেবল ক্রোধোন্মত্ত হয়ে নয়, সুস্থ-সবল মস্তিষ্কে ধারালো ছুরি দিয়ে কুপিয়ে ইবাকে খুনের পরও পরিবারের অন্যান্যদের হত্যার চেষ্টা করেছিল আসামি। ভাগ্যক্রমে অন্যরা চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে গেলেও ঘটনার দিনই প্রাণ হারাল ইবা। মোসাদ্দেক আদালতে তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগের সামান্য প্রতিবাদও করল না। শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে একটু প্রতিবাদ জানালেন আসামিপক্ষের উকিল। কিন্তু তাতে আদালতের বিচার কাজে কোনো প্রভাবই পড়লো না। বাদীপক্ষ আর সাক্ষীদের কথাই বিশ্বাস করলেন বিচারক। মামলাও বেশি দিন চলেনি। সাক্ষ্য-প্রমাণ সুস্পষ্ট বলে অল্প সময়ে রায় দিতে সমস্যা হলো না আদালতের। আসামির মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো সহজেই। দায়রা জজ প্রচলিত আইনের বিধান মতে মামলার রায়ে লিখলেন, ‘একেবারে না মরা পর্যন্তই ফাঁসিতে ঝুলতে হবে আসামিকে...।’ পরিকল্পিতিভাবে বড় নির্দয়ভাবে খুনটি করে দণ্ডবিধির তিনশ’ দুই ধারায় বেঁচে থাকার সম্পূর্ণ অধিকারটুকু হারিয়েছে আসামি মোসাদ্দেক। ন্যায় বিচারের তাগিদে কখনো বড় নির্দয় আইন-আদালতও, ইবাকে খুনের মামলার রায়ে বিষয়টি ফের জানা গেল কী?