সেলিম আহমেদ
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৭ পিএম | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৮ পিএম
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। ছবি: সংগৃহীত
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। বর্ষাকাল পেরিয়ে শরৎ ঋতুতে পা দিতেই হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে তলিয়ে গেছে দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের জেলাগুলো। ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম ও মৌলভীবাজারসহ বেশ কিছু জেলায় বন্যায় দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। সর্বশেষ ২৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় ২৭ জন মারা গেছেন। আর ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।
দেশের এই আকস্মিক বন্যার কারণ ও আগামী বন্যা মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের মুখোমুখি হয়েছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম আহমেদ।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই আকস্মিক বন্যার কারণ কী?
এই বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ বৃষ্টি। আবার সেই বৃষ্টি যখন হয়েছে পানি ছাড়ার আগে ভারতের উচিত ছিল আমাদের জানানো, কিন্তু জানায়নি। বর্ষায় বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ওপর সঠিক নজরদারি ও শক্ত পানি কূটনীতি না থাকায় উজান থেকে যে কোনো সময় বাঁধ, স্লুইস গেট, ব্যারাজ খুলে দেওয়া হয়। আর এ কাজটি করা হয় আমাদের না জানিয়েই। নোয়াখালী-ফেনীতে আজকের বন্যার কারণ সেটাই। আবার বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সরকারকে ঠিকমতো সহযোগিতা করেনি। এসব বহুমুখী সমস্যার কারণেই এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে এ সরকার আসার পর জুডিশিয়াল ক্যু হয়েছে, আনসারদের ক্যু হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রশাসনে এখনো অনেক আওয়ামী লীগার বসে আসে। তারা বসে আছে সরকারকে এ রকমের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য। সব মিলিয়েই এ অবস্থা হয়েছে।
আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তর অতীতেও বলেছে, এখনো বলছে তারা ভারতের কাছ থেকে আবহাওয়ার তথ্য ঠিকমতো পায় না। যার ফলে বাংলাদেশেও ঠিকমতো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। কতটুকু সত্য?
এটা পুরোপুরি সত্য। আবার বাংলাদেশও তথ্য ঠিকমতো নিতে চায় না এটাও সত্য। আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়া নিয়ে সিরিয়াস নয়।
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে না। এটা আপনি কীভাবে দেখছেন?
উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদীগুলোর পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে না-এটা পুরোপুরি সত্য। উজানে বাঁধ দিতে বলছে কে? তারা কি আমাদের দেশের অনুমতি নিয়ে বাঁধ দিয়েছে? আবার আমাদের দেশের তৎকালীন সরকারও এটা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। ভারতকে তোষণ করতে আমাদের দেশের অতীতের সরকারগুলো বসে ছিল। আর ভারত সেই সুযোগ নিয়েছে।
অনেকে বাঁধের বদলে বাঁধ দেওয়ার কথা বলছেন। বিষয়টি কি যৌক্তিক?
খুনের বদলে খুন যেমন কোনো সমাধান নয়, বাঁধের বদলে বাঁধও বন্যার সমাধান নয়। এগুলো আজগুবি চিন্তা। বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ আটকে রাখা যায় না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তঃসীমান্ত নদীতে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সমান অধিকার। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে। বর্ষাকালে যেন অতিরিক্ত পানি না আসে, আবার শুষ্ক মৌসুমে যেন পানি কম না পাই। এজন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে।
অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় উজানের পানি আটকাতে ভারত যেসব আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাঁধ দিয়েছে, সেসব নদীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঁধ দেওয়ার কথা বলছেন। এজন্য টাকা-পয়সাও দিতে চাইছেন। আমি বলব-সরকারের এখন টাকার অভাব আছে, এ টাকা সরকারকে দিয়ে দিন। বাংলাদেশ ভাটির দেশ। স্বাভাবিকভাবেই উজানের পানি এখান দিয়েই নামবে। বেশি বৃষ্টি হলে সেই পানি সাগরে যেতে না পারলে বন্যা হবে। বাঁধ দিয়ে দিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে। এ ছাড়া এতগুলো বাঁধ দিতে ব্যয় কত হবে সে ধারণাও নেই অনেকের। বাঁধের বিপরীতে সমাধান হচ্ছে বাঁধ সরিয়ে দেওয়া।
ভারত ৩০টি আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাঁধ দিয়ে আমাদের নদনদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট করেছে। অথচ আন্তঃসীমান্ত নদীতে কিছু করতে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সম্মতি নিতে হয়। সেটা তারা করেনি। এখন ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। প্রয়োজনে বাঁধ নির্মাণে যে খরচ হয়েছে তার একটা অংশ আমরা দিয়ে দিতে পারি। তারা শুষ্ক মৌসুমে পানি কম দিচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে বেশি পানি ছেড়ে দিচ্ছে। এতে একদিকে নদীগুলো প্রবাহ হারিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বর্ষাকালে বন্যার কবলে পড়ছে দেশ। ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসে কোন মৌসুমে কতটুকু পানি আসা যৌক্তিক সেটা নির্ধারণ করতে হবে। সেটা বাস্তবায়নে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। এটা আমাদের অধিকার।
বন্যা নিয়ে আমাদের করণীয় কী?
বন্যাপরবর্তী সময়ে রাস্তা-ঘাট, অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা, দুর্গত অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে গেছে, সেটাকে নতুন করে ঠিক করতে হবে। এসব মোকাবিলার জন্য দুর্গত এলাকার জনগণকে সুদমুক্ত লোন দিতে হবে। সরকারি যে প্রণোদনা যাবে তা সরকারের আগের পদ্ধতিতে না দিয়ে নতুন পদ্ধতিতে দিতে হবে। এসব কর্মকাণ্ডে ছাত্রদের রাখতে হবে। স্থানীয় দুর্যোগ মোকাবিলা কমিটির সঙ্গে তাদের যোগ করতে হবে। এসব কাজ এখনই করতে হবে। সেই সঙ্গে ত্রাণ হিসেবে কোনো ধরনের খাদ্য সামগ্রী না দিয়ে নগদ টাকা দেওয়াই উত্তম হবে। টাকা দিলে স্থানীয় অর্থনীতি লাভবান হবে। আবার মানুষজন তার প্রয়োজন অনুযায়ী জিনিসপত্র ক্রয় করবে।
বন্যা নিয়ে আগামীতে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?
এটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার। জয়েন্ট রিভার কমিশনকে আগে ঠিক করতে হবে। আমরা দেখছি নতুন সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। আশা করছি তারা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বিষয়টির সমাধানে এগোবে। ভুয়া আশ্বাস না দিয়ে বাস্তবে কাজ করতে হবে। ভারতকে চাপ দিয়ে এসব বিষয় সমাধান করতে হবে।
এ ছাড়াও বন্যার ঝুঁকি কমাতে প্রথমত ভারত যেসব নদীতে বাঁধ দিয়েছে সেগুলোতে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। পানিপ্রবাহ নিয়ে সার্বক্ষণিক তথ্য উভয় দেশ পাবে এবং পানি ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত দুই দেশ মিলে নেবে। প্রয়োজনে বাঁধগুলো নির্মাণে ভারত যা খরচ করেছে, তার অংশ আমাদের দিয়ে দিতে হবে। শর্ত একটা-নিয়ন্ত্রণ যেন দুই দেশেরই থাকে। দ্বিতীয়ত উভয় দেশের জন্য স্মার্ট বন্যা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাপানে যেভাবে সুনামি সতর্কতা দেওয়া হয়, তেমনি সাধারণের বোধগম্য ভাষায় বন্যার কয়েক দিন আগেই সবার মোবাইলে সতর্কবার্তা পাঠাতে হবে।
আমাদের নদ-নদী, হাওরাঞ্চল ভরাট হওয়াও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার অন্যতম কারণ। এটি কতটা সঠিক?
বন্যার জন্য এটাও একটা কারণ। আমাদের নদ-নদী, হাওর বিগত ১৫ বছরে প্রচুর দখল হয়েছে। নির্মোহভাবে-দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে না তাকিয়ে এসব জায়গা দখলমুক্ত করতে হবে। না হলে এ সংকট থেকে সমাধান মিলবে না।