কবি ত্রিদিব দস্তিদার: একা এক মানুষের গল্প

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:০৯ পিএম | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৮ পিএম

কবি ত্রিদিব দস্তিদার। ছবি: সংগৃহীত

কবি ত্রিদিব দস্তিদার। ছবি: সংগৃহীত

অর্ধ-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাড্ডার ফুটপাতে মৃতপ্রায় সন্ধ্যায়। এলাকাটা সরগম থাকে দিন রাত, মানুষ আর ট্রাফিকের ভিড়ে। কেউ কারও খোঁজ রাখে না, সবাই সামনের দিকে চলছে। চারিদিকে লোকজন কিন্তু তার ভেতরেও এক অদ্ভুত একা ভাব সবার চলনে বলনে। কথা বলার সময় নাই কারো সাথে। রাস্তার ঝুট ঝামেলায় হারিয়ে যায় মানুষ, গাড়ি, ট্রাক, সিএনজি আর বাস।

‘কোনো জায়গা নাই, কোনো জায়গা নাই’ ঘোষণা দিতে দিতে সবাই চলছে। সাথে থাকলেই কেউ সবার হয় না। যেমন একটা খালি বাস এই জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে কখন লাইট সবুজ হবে, এগোবে, যদিও তার ভেতরে কেউ নেই। এটা দেখে কেন মনে হলো কবি ত্রিদিব দস্তিদারকে, কবি আর উন্মূল মানুষ, জানি না। কই যাবে, কোথায় যাবে জানে না। তার কেউ ছিল না বলে সব মানুষের মাঝে থেকেও একা? আমার এমএ ক্লাসটা চলে ৯.৩০ পর্যন্ত, নামতে নামতে ১০টা বেজে যায়, তখনো ভিড় থাকে, ভাঙা খালি বাসের মতো দেখতে একজন মানুষ, এমন মানুষকে, কে আর মনে রাখে?

দুই

ত্রিদিব চাঁটগার মানুষ, দস্তিদার পরিবার সবার চেনা। বিপ্লবী, বিদ্রোহী, সম্ভ্রান্ত। বাম রাজনীতিতে অনেকেই সক্রিয়, তবে ত্রিদিবের বাবা তেমন ছিলেন না। তিন সন্তান হওয়ার পর কারণ জানি না, ত্রিদিবের মা মারা যান। বাবা তাদের সাথে কিছুদিন ছিলেন, কিন্তু তারপর একদিন গৃহ/সংসার ত্যাগ করে চলে যান। কেন? কোথায়? ত্রিদিব জানত না বা বলত না। আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় তারা বড় হয়, দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তারপর ত্রিদিব আর সেই শহরে থাকেনি, চলে আসেন ঢাকায়। তার উন্মূল জীবন সেখান থেকে শুরু সত্তর দশকের মাঝামাঝি। 

তিন

সাহিত্য পত্রিকা সমকাল অফিসে তার পরিচয় হয় কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প, সেই সূত্রেই আমার সাথে পরিচয়। হাসান ভাই এসে বললেন, ‘একটা অ্যাসিস্ট্যান্টের পদ খালি আছে, ওকে নিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করো।’ অতএব ব্যবস্থা করলাম। সেভাবেই সহকর্মী, সেভাবেই এক অফিসে দুই কবি। আমি যেমন সকাল বেলা হাসান ভাইয়ের লেখা নতুন পদ্য শুনতাম, তেমনি দুপুরে শুনতাম ত্রিদিবের কবিতা। 

চার

ত্রিদিবের কেউ ছিল না এটা ঠিক না, দুই বোন ছিল যাদের জন্য সে সব দিতে রাজি ছিল। একবার পরিবারের কোনো একটা ঘটনা ছিল-ত্রিদিব ছুটি চাইল। কিন্তু সরকারি চাকরির নিয়ম, কনফার্ম হওয়ার আগে তার ছুটির সুযোগ নেই। আমি বললাম, কী করে যাবেন? সে চিৎকার শুরু করে দিল, ‘আমার দরকার নেই চাকরির।’ এই বলে অফিস থেকে চলে গেল। এর সপ্তাহখানেক পর দেখি চুপচাপ আমার টেবিলের সামনে বসা, কোনো কথা নেই। হাসান ভাই খুব চটেছিলেন, আমি কিছু বলিনি। শেষে কিছু একটা দেখিয়ে প্রেজেন্ট দেখিয়ে দিলাম। ত্রিদিব প্যাভিলিয়নে ফেরত এলো মাঠ থেকে। তবে এই রক্তের জগৎ কত দিন ছিল পরে জানি না। 

পাঁচ

অথচ ত্রিদিবের একজন আপন মানুষ ছিল যাকে সে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সংসার করতে পারেনি। ধরা গেল মেয়েটার নাম মারিয়া, চাঁটগার পর্তুগিজ পরিবারের মেয়ে। বোধহয় পরিচয় হয় ১৯৭১-এ, সেই পালাবার, বাঁচার, প্রেমে পড়ার বছর। মৃত্যুর বছর। তারা দুজনে ঠিক করে পরিবার যেহেতু মত দেবে না, তাই তারা বিয়ে করে ফেলবে। তাই হয়। তারপর মেয়ে-ছেলে ফিরে যায় নিজ নিজ বাড়ি। কিন্তু এই সব কথা তো চাপা থাকে না। মেয়ের পরিবার এত রেগে যায় যে জোর করে তাকে ঢাকা এবং সেখান থেকে ইউরোপের কোথাও পাঠিয়ে দেয়। মেয়ে প্রতিবাদ করল না কেন? 

তখন আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এসব হতো কম, অনেককে দেখেছি বাবা-মায়ের জোর করে দেয়া বিয়ে মেনে নিতে। ত্রিদিবের সাথে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। যেই বা এলো, সেও চলে গেল, হারিয়ে গেল।

ছয়

১৯৮৪ সালে আমি ওই চাকরি ছেড়ে ফুল টাইম সাংবাদিকতায় চলে যাই। তারপর দেখা হয়েছে কম। শুনেছি তার চাকরি যায় প্রকল্প বন্ধ হলে, তবে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে একটা চাকরি হয়, সেটাও যায় একসময়। তারপর আর খবর রাখিনি, যোগাযোগ ছিল না। মৃত্যুর খবর পেলাম পত্রিকায়। সে যে আমার সমবয়সী জানতাম না। কবিতার মধ্যেই সব ছিল তার। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এই সব লেখেন কাকে নিয়ে?’ চুপ করে ছিল। তারপর ভেবে বলল, ‘নিজেকে নিয়ে বোধহয়, জানি না।’ সংসার ছিল না, পরিবার না, এমনকি নিশ্চিত থাকার জায়গাও নয়। প্রথমে থাকত মেসে, পরে উঠল হেটেলে, সেখানেই একরাতে অসুস্থ হয়ে সকালে মৃতদেহ হয়ে মুক্তি পেল।

সাত

ঘোর কাটলে দেখলাম খালি বাসটা ট্রাফিকের স্রোতের সাথে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। নিচের কবিতাটি আমার প্রিয়, তাই শেয়ার করলাম। বিদায় ত্রিদিব, সবার সাথে ভালো থাকবেন। ওখানে সবাই আপনজন আপনার।

তোমার চোখজোড়া পাঠ-অভ্যাসের মতো
পড়ে আছে আমার পড়ার টেবিলে
আমি তোমার চোখের মুখবন্ধ খুলি,
সমতলে গড়ে ওঠা কুঁড়েঘর, ছাতা ।
ঝরনার ঠোঁটে বসে থাকা শুভ্র পাথর প্রেমিক ।
তোমার চোখজোড়া লুক্কায়িত ঝিনুক-শঙ্খ
বুকে তার কান্নার গভীর সমুদ্র,
আমি তোমার চোখের শব্দ মুখস্থ করি ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh