মাহাবুবা আখতার
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৭ পিএম
ডিজিটাল ডিমেনশিয়া। প্রতীকী ছবি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটি টেক-ফার্মে চাকরি নিয়েছেন রুবি। ভালোই চলছিল সবকিছু, কিন্তু কিছুদিন থেকে একটি অস্বস্তিকর সমস্যায় পড়েছেন তিনি। ইদানীং কেমন যেন সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করেছেন। এই তো সেদিন চুলায় দুধ জ্বাল করতে দিয়ে কম্পিউটারে বসেছিলেন ছোট একটি জরুরি ই-মেইল দেওয়ার জন্য। কিন্তু কম্পিউটার স্ক্রিন ওপেন করতেই সবকিছু যেন বেমালুম ভুলে গেলেন। তার চোখ যায় ফেসবুকের নোটিফিকেশনে। কৌতূহলী হয়ে ফেসবুকে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর সময় যেন উড়ে যায়। এদিকে কখন যে তার চুলায় বসানো দুধ উতলে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এটা তিনি জানেনই না। পরে ক্ষণিকের জন্য চেয়ার থেকে উঠলেই সব মনে পড়ে তার। দৌড়ে কিচেনে গিয়ে রুবি দেখেন চুলা নিভে গেলেও গ্যাস বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি চুলা বন্ধ করে জানালা খুলে দেন। এ সময় তার মনে পড়ে তিনি যে জরুরি মেইলটি করার জন্য কম্পিউটারে বসেছিলেন সেটি তো পাঠানোই হয়নি।
আধুনিক টেকনোলজির এই যুগে এমন ভুলে যাওয়ার ঘটনা প্রায় প্রতিটি মানুষের সঙ্গে কোনো না কোনো সময় ঘটেছে। এমন ঘটনাকে গবেষকরা বলছেন ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’। এটি মস্তিষ্কের একটি ক্ষয়জনিত রোগ-যাতে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি, স্মৃতিশক্তি এবং ব্যক্তিত্বের ধরন পরিবর্তন হয়ে যায়। অনেক ধরনের ডিমেনশিয়া রয়েছে, যার মধ্যে আলঝেইমার্স ডিজিজ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। মস্তিষ্কের যে স্নায়ুকোষগুলো আছে তার মধ্যে এক ধরনের প্রোটিন জমা হয়, এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বস্তু প্লাক বসে। ফলে মানুষের ভেতরে চিন্তার ক্ষমতা, আচরণ, ব্যক্তিত্ব এবং ভুলে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। ৬৫ বছর বয়সের আগে সাধারণত ডিমেনশিয়া হয় না বলেই জানত চিকিৎসকরা। কিন্তু ডিজিটাল ডিমেনশিয়া পূর্বের সকল গবেষণাকে ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছে। মূলত ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার শিকার হচ্ছেন তরুণরা বেশি, যারা প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ যারা মোবাইল ও কম্পিউটার বেশি ব্যবহার করেন।
ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার লক্ষণ
অন্যান্য শারীরিক রোগের মতো ডিজিটাল ডিমেনশিয়াকে সেভাবে নির্ণয় করার উপায় নেই। তাই এর লক্ষণগুলো ঠিক কী তা বলা কঠিন। যা-ই হোক, নাম থেকে বোঝা যায়, এই রোগের কিছু উপসর্গ ডিমেনশিয়ার মতো হতে পারে, যেমন-
প্রথমত ভুলে যাওয়ার প্রবণতা হবে, নিকটবর্তী স্মৃতি কমে যাবে। আজকে সকালে কী খেয়েছেন মনে করতে পারবেন না, গতকাল রাতে কী করেছেন মনে করতে পারবেন না, একই কথা বারবার বলতে থাকবেন, একই কাজ বারবার করতে থাকবেন। কারণ তিনি ভুলে যাচ্ছেন।
দূরবর্তী স্মৃতিশক্তিগুলো, যেগুলো মস্তিষ্কে ইতোমধ্যে সঞ্চিত আছে সেগুলো থাকবে। ১০ বছর আগে কী হয়েছিল, ২০ বছর আগে কী হয়েছিল সেগুলো মনে থাকবে। কিন্তু একদম নিকটবর্তী স্মৃতি ধ্বংস হবে। সাম্প্রতিক কিছু মনে রাখতে পারবেন না।
দ্বিতীয়ত ডিমেনশিয়ার মতোই ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম, চিন্তা করার প্রবণতা, যুক্তি দিয়ে কিছু করার প্রবণতা, সাধারণ যোগ বিয়োগ করার প্রবণতা, কোনো কিছুকে দেখে সেটাকে আবার তৈরি করার প্রবণতা, অন্যকে অনুকরণ করা ইত্যাদির প্রবণতা কমতে থাকবে।
তৃতীয়ত এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটবে ও আচরণজনিত সমস্যা হবে।
কীভাবে প্রতিরোধ করবেন ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’?
প্রযুক্তি সমাজব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিয়েছে এবং এগিয়ে নিয়ে গেছে। সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে সংযোগ থেকে শুরু করে আমাদের শ্রেণিকক্ষ এবং হাসপাতালের দক্ষতার উন্নতি এবং আরও অনেক কিছু এখন সম্ভব প্রযুক্তির কল্যাণে।
কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে অত্যধিক প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে যে কিশোর-কিশোরীরা তাদের ফোনে দিনে প্রায় ৬ ঘণ্টা ব্যয় করে, তাই ডিজিটাল ডিমেনশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার মূল চাবিকাঠি হলো সংযম।
সুতরাং এখানে কয়েকটি পদক্ষেপ রয়েছে যা প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাবকে অফসেট করতে পারে :
নোটিফিকেশন কমান
স্মার্টফোনের নোটিফিকেশন কাস্টমাইজ করুন। নোটিফিকেশন যত কম আসবে, স্মার্টফোন দেখার হার তত কমবে।
ব্যবহারের সময় কমান
স্মার্টফোন ব্যবহার কমান। দিনে কতবার স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন, তা নির্ধারণ করুন। প্রথমে সিদ্ধান্ত নিন দিনে ২০ বারের বেশি স্মার্টফোন দেখবেন না। এ ছাড়া খাওয়া ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন না।
বন্ধ করুন সোশ্যাল সাইট
অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ সরিয়ে ফেলুন। স্মার্টফোনে ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপগুলো অদরকারি। পারলে এ দুটি অ্যাপ সরিয়ে ফেলুন। স্মার্টফোনে আরও অনেক অ্যাপ আছে, যেগুলো সময় নষ্ট করে। এ ধরনের অ্যাপ সরালে সময় বাঁচবে এবং ফোনের স্টোরেজ ও চার্জ কম ফুরাবে।
ঘুমানোর আগে ফোন বন্ধ করুন
ঘুমানোর আগে ফোন বন্ধ করার বিষয়টি অনেকে জানলেও বাস্তবে তা করেন না। ঘুমানোর সময় ফোন বন্ধ করলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই ভেবে ফোন বন্ধ করে দিন। অভ্যস্ত হয়ে গেলে ঘুম ভালো হবে। অ্যাপের সাহায্য নিন। গুগলের প্লে স্টোরে স্মার্টফোনের ব্যবহার কমাতে পারে এমন অনেক অ্যাপ পাবেন। অ্যাপ ডেটক্স ও রেসকিউ টাইমস এমন দুটি অ্যাপ। অ্যাপ ডাউনলোড করে প্রয়োজনমতো স্মার্টফোনের ব্যবহারে সময় ঠিক করে নিন।
হাতঘড়ি ব্যবহার করুন
স্মার্টফোনের কারণে হাতঘড়ির ব্যবহার প্রায় কমে গেছে। সময় দেখতে মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে। একবার স্মার্টফোনে গেলে নোটিফিকেশন, ফেসবুক, টুইটারে ঢুকে পড়ছে। স্মার্টফোনে অ্যালার্মের পরিবর্তে অ্যালার্ম ঘড়ি ব্যবহার করুন। আসক্তি কাটাতে পুরনো দিনের প্রযুক্তিতে ফিরে যান।
ফিচার ফোন ব্যবহার করুন
স্মার্টফোনের আসক্তি যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে, তবে স্মার্টফোন বাদ দিয়ে ফিচার ফোন ব্যবহার শুরু করুন। টানা এক সপ্তাহ ফিচার ফোন ব্যবহার করে আবার স্মার্টফোনে ফিরতে পারেন। এতে আসক্তি কিছুটা কমবে।