সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী: অরাজনৈতিক দৃশ্যের আড়ালে গণমানুষের রাজনীতি

সুজিত সজীব

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৮ পিএম

প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমার পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমার পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০), সীমাবদ্ধ (১৯৭১) এবং জন অরণ্য (১৯৭৫)-চলচ্চিত্র তিনটিকে সত্যজিৎ রায়ের ‘কলকাতা ত্রয়ী’ বা ‘রাজনৈতিক ত্রয়ী’ বলা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমাটি মুক্তি পায় কলকাতা শহরের অস্থির সময়ে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর কলকাতা তখনো শরণার্থী সমস্যায় জর্জরিত, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নকশালপন্থি আন্দোলন। সমাজজুড়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে নানামুখী পরিবর্তন। তরুণদের একাংশ বেকারত্ব সমস্যায় জর্জরিত, আরেক অংশ সমাজ পরিবর্তনের বিতর্কিত বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে জড়িত। নৈতিক স্খলন এবং অবক্ষয়ের উপাদানগুলোও তখন ক্রমান্বয়ে সমাজে প্রবেশ করছে। এসব উপাদান যে শুধু তরুণদের প্রভাবিত করছে তা নয়, বরং সমাজের সকল শ্রেণিই এই পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মুক্তির পর সত্যজিৎ ব্যাপক সমালোচিত হন। চলচ্চিত্রটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অরাজনৈতিক জীবন নাকি অরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক জীবন! এ নিয়ে বেশ তালগোল আর আলোচনার জট পাকিয়েছিলেন সমালোচকরা। 

সত্যজিতের বিরুদ্ধে সমালোচকদের একটা প্রচলিত অভিযোগ, তিনি বড্ড গা বাঁচিয়ে চলেন, তিনি খুব অরাজনৈতিক (apolitical)। এর জবাব ১৯৮১ সালে Cineaste ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় নিজেই দিয়েছিলেন। তবে তার সিনেমায় রাজনীতি নেই, আমি এই কথাটা মানতে নারাজ। আমার মতে, সমস্যাটা আসলে সত্যজিতের সিনেমাতে না। সমস্যাটা সমালোচকদের প্রত্যাশিত গল্প না পাওয়ার হতাশা কিংবা মন-পছন্দ মতাদর্শের গুণগান খুঁজে না পাওয়ার ক্ষোভে লুকিয়ে আছে। সত্যজিৎ রায়ের প্রতিটি ছবিতেই রাজনীতি আছে, তবে তা সাধারণ মানুষের জীবনের অংশ হিসেবে। একটু লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায় চরিত্রের জীবনগাথার ভেতরে রাজনীতির অ আ ক খ-এর সংসার। 

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমার প্রেক্ষাপট ১৯৭০ সাল। কলকাতা যখন গণ-আন্দোলন আর পুলিশের গুলিতে উত্তাল তরঙ্গের মতো উথালপাথাল। সেই সময় সত্যজিৎ নির্মাণ করলেন প্রতিদ্বন্দ্বী। চলচ্চিত্রটি সরাসরি রাজনৈতিক না হলেও, রাজনীতির আবহাওয়ায় সে নিঃশ্বাস নেয়। তার গল্পের ভেতর রাজনীতি আস্ফালন করে। সে হাহাকার করে মানুষের ক্ষুধায়, অভাবে, এক টুকরো সুখের আশায়। 

সিনেমার মূল চরিত্র সিদ্ধার্থ। যিনি চাকরি খুঁজছেন আর ফাঁকে ফাঁকে কলকাতা শহরটাকে দেখছেন। উত্তাল সময় তাকেও মনে মনে বিপ্লবী করে তোলে। তবে তিনি সে স্রোতে গা ভাসান না। বিপ্লব তার কাছে বিলাসিতা মাত্র। বাবা মারা যাওয়ায় সিদ্ধার্থকে মেডিক্যাল কলেজ ছাড়তে হয়েছে, ছোট ভাইটা নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, একমাত্র বোনটা চাকরির নামে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছে। নাহ, রাজনীতি আর সমাজের পরিবর্তন আনার ফুরসত সিদ্ধার্থের নেই। গৌতম বুদ্ধের মতো ঋষিসম মৌনতা নিয়ে তিনি সব সয়ে যেতে থাকেন... 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। সত্যজিতের অন্যান্য ছবির তুলনার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে ক্যামেরার চলন বেশ আলাদা। ট্রাইপডের এক পা গুটিয়ে দু পায়ে হেঁটে ক্যামেরা ঘুরে বেড়িয়েছে পুরো কলকাতা। সমুদ্রের ড্রিম সিকোয়েন্সকে সত্যজিৎ দেখিয়েছেন ফেলিনীয় পরাবাস্তবতায়। স্বপ্নে সে সবার আগে দেখে দেহপাসারিণী এক নার্সকে আর তার প্রেমিকা কেয়াকে দেখে সবার শেষে। ছবির কেয়া আর নার্স চরিত্র দুটি এখানে ম্যাডোনা-হোর পোলারিটি তৈরি করে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh