অতিশব্দের মোটরবাইক

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১৯ পিএম

মোটরসাইকেল। ছবি: সংগৃহীত

মোটরসাইকেল। ছবি: সংগৃহীত

পথ চলতে হঠাৎ দ্রুতগতিতে চালিয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলের বিকট শব্দে পিলে চমকে যায় সাধারণ জনগণের। এত দ্রুত এই শব্দের আগমন এবং প্রস্থান যেন, গায়ের ওপরেই উঠে পড়বে বাইকটি। এর উৎস হলো উচ্চ শব্দের হলার (একজস্ট/সাইলেন্সার), যা ব্যবহারের প্রবণতা ইদানীং বেড়ে গেছে তরুণ মোটরবাইক চালকদের মাঝে। দলবেঁধে চলাচল করা এসব উচ্চ শব্দের মোটরবাইকের কারণে পথচারী ও যাত্রীদের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক।

অপ্রয়োজনে এক্সিলেটর চেপে বিকট শব্দ সৃষ্টি করা এসব মোটরসাইকেল চালকদের প্রায় সবাই নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। আগে এমন মডিফাইড বাইকের সংখ্যা কম থাকলেও এখন সেই সংখ্যা বেড়েছে প্রায় কয়েক গুণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাইকগুলোকে মডিফাই করে পরিণত করা হচ্ছে এমন অস্বস্তিকর যানবাহনে। আইনে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছে না কেউ। 

কেবল নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করতে এবং শখের বশে দামি মোটরবাইকটির ক্ষতি করে এমন উচ্চ শব্দের বাইকে রূপান্তর করেছে অনেক কিশোর। এ জন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করছে। অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে শব্দ দূষণের চেয়ে ভয়ঙ্কর মাত্রায় থাকা নগরীতে এই বাইকগুলো বাড়াচ্ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের সকল বাসিন্দার স্বাস্থ্যঝুঁকি।

সিয়াম নামের এক কিশোর বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করায় তাকে পরিবার থেকে বাইক কিনে দেওয়া হয়। নিজের বাইকটিকে সবার থেকে আলাদা করতে হলার লাগিয়েছে ৮ হাজার টাকা খরচ করে। বন্ধুদের দেখে বাইকে এই মডিফাই করেছে সে। বর্তমানে এটি স্টাইল ও ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে বলে জানায় সে। প্রায় সব মোটর মেকানিক এই মডিফাই করতে পারে। 

সিয়াম জানায়, সে যখন বাইক নিয়ে যায় অনেক সময় পথচারীরা গালাগাল করে। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। শুধু ট্রাফিক পুলিশের চোখ এড়িয়ে চলতে হয়। 

মোটরসাইকেল মেকানিক হাসান জানান, আগে খুঁজেও এমন মোটরসাইকেল দেখা যেত না। এখন হলার লাগানোসহ নানা উপায়ে বাইকের শব্দ বাড়ানোর স্টাইল শুরু হয়েছে। গত ২ বছরে নগরীতে এমন বাইকের সংখ্যা লক্ষণীয় পর্যায়ে বেড়েছে। কেউ টাকা খরচ করে এটি করে, কেউ আবার বিনে পয়সায় কেটে ফেলে নিজের দামি বাইকের সাইলেন্সরটি। এতে বাইক চালালে স্বাভাবিক শব্দই বের হয় বিকট আকারে। টাকায় হোক বা বিনে পয়সায়, দুই ক্ষেত্রেই এমন মডিফিকেশনে বাইকের ক্ষতি হয় বলে জানান তিনি। এতে তেল খরচ বাড়ে, দীর্ঘদিন এমন অবস্থায় চলা বাইকের ইঞ্জিনে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এখন যার বাইক সে যদি ক্ষতির পরও এমন মডিফাই করে তবে সে ক্ষেত্রে বলার কিছুই নেই। 

বিকট শব্দে বিরক্ত আফরোজা আক্তার নামের এক নারী পথচারী বলেন, দিনে-রাতে যে কোনো সময় এমন বিকট শব্দের বাইকগুলো চলাচল করে। হাসপাতাল রোডে একটি ভবনের ৪ তলায় বসবাস করেন তিনি। রয়েছে ২ বছরের এক সন্তান। প্রায়ই সড়ক দিয়ে বিকট শব্দে যায় এই বাইকগুলো। ৪ তলা বাসায় থেকেও হলারের শব্দে আঁতকে উঠতে হয়। 

এ বিষয়ে নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ডা. মেজর (অব.) শেখ হাবিবুর রহমান বলেন, উচ্চ শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণ শক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। শব্দের পরিমাণ ৬০ ডেসিবেল হলে মানুষ বিরক্ত হয়। অন্যদিকে শব্দের পরিমাণ ৯০ ডেসিবেল হলে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়। কানের সঙ্গে মস্তিষ্ক সংযোগস্থলে আঘাত আসে। যার ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা, শারীরিক নানাবিধ সমস্যাসহ বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে তরুণরা শখের বশে মোটরবাইকে যে বিকট শব্দের সাইলেন্সর ব্যবহার করে এবং হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার করে, তা সাধারণত ৯০ ডেসিবেলের ওপর হওয়ায় এটা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এর প্রভাবে ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। তাই এসব বিষয়ে এখনই প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।

অভিযোগ আছে হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন পদক্ষেপ নিলেও বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর প্ররোচনায় তরুণরা এসব বিকট শব্দের বাইকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। বাইক চালকরা হাইড্রলিক হর্নের বিকট শব্দকে শখের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলেও বিশেষজ্ঞরা এটাকে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর কারণ হিসেবেই বিবেচনা করছেন।

এ বিষয়ে ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই ধরনের বাইকের হলার, উচ্চ শব্দের হর্ন লাগানো অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। ধরা পড়লেই এদের জরিমানা করা হয়। এমন বাইকারদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও কঠোর হবে ট্রাফিক বিভাগ। এ সংক্রান্ত নির্ধারিত আইনের ধারা-৮৮ মোতাবেক নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত উচ্চমাত্রার কোনোরূপ শব্দ সৃষ্টি বা হর্ন বাজানো বা কোন যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা হর্ন মোটরযানের স্থাপন সংক্রান্ত ৪৫-এর বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানাসহ অনধিক ১ বছর দণ্ড দেওয়া যেতে পারে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh