বখতিয়ার আবিদ
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ পিএম
হাতপাখা। ছবি: লেখক
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার মদনপুর গ্রাম-সদ্যই বন্যার পানি নেমেছে গ্রাম থেকে। বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতি দেখতে এবাড়ি-ওবাড়ি যেতে হচ্ছে তখন। প্রতিটি বাড়িতে একটা আশ্চর্যরকম মিল ছিল। বারান্দা কিংবা বসার ঘরে একটু উঁকি দিলেই থরে থরে সাজানো রঙ-বেরঙের হাতপাখার দেখা মিলছিল। উঠোনের কোণে বাঁশ কাটছাঁট করছেন বাড়ির কর্তা, বারান্দায় বসে হাতপাখায় নকশা করছেন গৃহকর্ত্রী-তাদের ঘিরে গল্পের আসর জমিয়েছেন প্রতিবেশীরা, একমনে কাজ করে যাচ্ছেন তারা-ফাঁকে ফাঁকে একটু-আধটু গল্পও জুড়ে দিচ্ছেন।
এমনই একটি বাড়িতে উঠোনে বসে কথা হলো মোহাম্মদ সালেক মিয়ার সঙ্গে। পান চিবোতে চিবোতে সহাস্যে সালেক মিয়া বলেন, ‘যে টাকা লাভ হয় তাতে ঠিকমতো আমার পানের পয়সাই ওঠে না!’ কিন্তু সালেক মিয়ার কথা মানব কেন, পুরো গ্রাম যে এই শিল্পের সঙ্গেই মিতালি পাতিয়েছে!
এ গ্রামে কার হাত ধরেই বা শুরু হলো এই শিল্পের? আলাপ এগিয়ে নিলেন সালেক মিয়া, ‘গ্রামে হাতপাখা বানানোর কাজটা প্রথম শুরু করেন আমার মামাশ্বশুর আব্দুল মোত্তালিব। বাণিজ্যিকভাবে যখন হাতপাখা বানানো শুরু করলেন, তখন মজুরির ভিত্তিতে গ্রামের অনেকেই কাজ করত তার বাড়িতে। তারপর তারা নিজেরা তৈরি করতে লাগল। এভাবেই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে।’ হাতপাখা তৈরি করার প্রথম ধাপ হিসেবে এ গ্রামের কারিগররা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পোশাক কারখানা থেকে ঝুটের কাপড় কিনে আনেন। সেসব কাপড়ের বিভিন্ন রঙ ও আকার থাকে। যারা জুটের ব্যবসা করেন তারা আকার ও রঙের ওপর ভিত্তি করে কাপড়গুলো আলাদা করে বস্তায় সংরক্ষণ করেন। এ গ্রামের কারিগররা তা কিনে আনেন। তারপর বাঁশ থেকে নির্দিষ্ট মাপের ফালি তৈরি করা হয়। ফালি তৈরির কাজটি পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই করে থাকেন। পাখার জন্য কিনে আনা কাপড়ে নারী সদস্যরা নানা ধরনের নকশা আঁকেন। সালেক মিয়া বলেন, ‘এ গ্রামে দুই ধরনের হাতপাখা তৈরি হয়। একটিতে হাতের সূক্ষ্ম নকশার কাজ থাকে আর অন্যটিতে থাকে ছাপ দেওয়া বিভিন্ন নকশা। হাতে নকশা করা পাখার পাইকারি মূল্য ৩০ টাকা আর ছাপ দিয়ে তৈরি পাখার পাইকারি মূল্য ১৬ টাকা, তবে দাম এদিক-ওদিক হয় মাঝেমধ্যে। একেকটি পরিবার বছরে ১৫-২০ হাজার পাখা তৈরি করে, আমি নিজে গত বছর ১৫ হাজার হাতপাখা তৈরি করেছি।’ সারা বছরই পাখা তৈরির কাজ চলে মদনপুর গ্রামে, শীতের মৌসুমে হাতপাখার বিক্রি হয় না বললেই চলে, কিন্তু সে সময়ও বন্ধ থাকে না তাদের কাজ। মৌসুমে যাতে আশানুরূপ হাতপাখা বিক্রি করতে পারেন সে জন্যই এভাবে নিরবচ্ছিন্ন কাজ চালিয়ে যাওয়া। শুধু লাভের আশাতেই নয়, মদনপুর গ্রামের নারীরা শখের বশে অবসর সময়ে হাতপাখার কাজ করেন। গৃহিণী মোসাম্মৎ আমেনা বেগম বলেন, ‘কাজটা করতে ভালো লাগে তাই করি। ঘরের কাজকর্ম শেষে বিকালের দিকে বাড়ির মহিলারা এক সঙ্গে বসি-হাতপাখার কাজ করি, কথাবার্তা হয়-একটু বাড়তি আয় হয়, সময়ও কাটে।’
আমেনা বেগমের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আব্দুল মোত্তালিবের সন্ধানে, তার হাত ধরেই তো শুরু হয়েছিল মদনপুরের হাতপাখা শিল্প। মূল সড়ক থেকে যে রাস্তাটি গ্রামে প্রবেশ করেছে সে রাস্তার মুখে একটি চায়ের দোকানে আড্ডায় মশগুল ছিলেন কিছু মানুষ, মোত্তালিবের বাড়ির খোঁজ জানতে চাইতেই দেখিয়ে দিলেন রাস্তা। বাড়ি গিয়ে জানা গেল মোত্তালিব ঘরে নেই, হাটে গেছেন। ব্যর্থ হয়ে ফেরার পথে গ্রামের দোকানটির সামনে এলে মোত্তালিবকে পাওয়া গেল, তিনি হাট থেকে ফিরছিলেন। মোত্তালিব বললেন, ‘তিরিশ বছর ধরে হাতপাখা বানানোর কাজ করছি। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে থেকে কাজটি শিখি। আট-দশ বছর আগে থেকে আমাদের গ্রামের সকলেই আমার দেখাদেখি হাতপাখা বানানোর কাজ শুরু করে, আগে বানাইনি কারণ তখন এত চাহিদা ছিল না, এখন বাজারে চাহিদা বেড়েছে। এ গ্রামে তৈরি হাতপাখা ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা কিনে নিয়ে যায়। এটা ভাবতে ভালো লাগে যে গ্রামে আমিই প্রথম এ কাজ শুরু করি।’