ফিল্ম নেগেটিভের সেই সব দিন

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ পিএম

ক্যামেরা। ছবি: সংগৃহীত

ক্যামেরা। ছবি: সংগৃহীত

ক্যামেরার রিল আর নেগেটিভের কথা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন। ফুজিকালার, কোডাক কোম্পানির ফিল্মই বেশি পাওয়া যেত। ক্যামেরায় ভরে ছবি তুলে তারপর অপেক্ষা-ছবি কেমন হবে, কতটা উজ্বল, কতটা অন্ধকার এসবের চিন্তা লেগেই থাকত।

আশির দশকের শেষ বা নব্বইয়ের শুরুতে ব্যক্তিগত ক্যামেরা মফস্বলে দেখা যেত না বললেই চলে। এ সময় ক্যামেরা ছিল পুরোটাই ফিল্মনির্ভর। তখন ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গেই এখনকার মতো ডিসপ্লেতে ছবি দেখা যেত না। এজন্য বেশ সময় অপেক্ষা করতে হতো। আগে ফিল্ম শেষ হবে, তারপর সেটি স্টুডিওতে বা ল্যাবে যাবে, তারপর বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা ওয়াশ শেষে হাতে আসবে ছবি। নিজ উদ্যোগে সেই ছবি বিলি করে একটু প্রশংসাই অনেক কিছু। 

তবে তখনকার সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারিবারিকভাবে ছবি তোলার একটা রেওয়াজ ছিল। বড় অনুষ্ঠানে তখনো ফটোগ্রাফারকে বাড়ি এনে একটা দুটো ছবি তোলা হলেও, সন্ধ্যার পরে স্টুডিওতে ছাড়া ছবি তোলা যেত না। মেয়ের ছবি ছেলের বাড়িতে পাঠানো, বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রীর ছবি তোলা, পিকনিকে বন্ধুদের নিয়ে ছবি তোলা, এলাকার একটু-পরিচিত ছেলেদের বিভিন্ন পোজের ছবি থাকত স্টুডিওতে টাঙানো। সে এক অন্যরকম সংস্কৃতি। 

দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির কল্যাণে এসেছে আধুনিক বা ডিজিটাল ক্যামেরা। যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের টুলস, যেগুলোর ব্যবহারে একটি ছবিকে ইচ্ছামতো এডিট (সম্পাদনা) করা যায়। নব্বই দশকেও এসব চিন্তা করা যেত না। তখন ইয়াসিকা ক্যামেরার বাজার। এই সব ক্যামেরা কারও হাতে থাকলেই তার গুরুত্ব বেড়ে যেত। বিয়েবাড়িতে কেউ একটা ক্যামেরা নিয়ে গেলে কত লোক ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করত তার শেষ নেই। শর্ষে ক্ষেত, পুকুর পাড়, গাছের ডাল, ফুলের ডাল ধরে নানা রকমের মুখস্থ পোজ ছিল ছবি তোলার ক্ষেত্রে। সে সময়ের অ্যানালগ ক্যামেরায় ছবি তুলতেন একজন, নাম মোতালেব বিশ্বাস, থাকেন ধানমন্ডিতে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তার শখ ছিল একটা ক্যামেরার। কলেজে পড়ার সময় তিনি এক আত্মীয়ের মারফত পান ক্যামেরা। তারপর সেটা দিয়ে ছবি তুলে বেড়াতেন। আশপাশের বাসার কোনো অনুষ্ঠান হলে তিনিই ছবি তোলার ডাক পেতেন। চাকরি পাওয়ার পর আর ছবি তোলা ওভাবে হয়নি। তবে ছবি তুলে ওয়াশ করার পর ভালো ছবি তোলার তৃপ্তির কথা স্মৃতি থেকে বললেন, সে আনন্দ বিশাল। 

তবে মাসুদ খান এক সময় ‘দৈনিক রূপালী’ পত্রিকায় ছবি তুলতেন। তিনি বলেন, আমরা সাদাকালো ছবি তুলতাম। স্টুডিও ঠিক করা ছিল, সব সাংবাদিক ওখানেই যেত। সেসব ছবির মজাটা ছিল আলাদা। তিনি বলেন, ডিজিটাল ক্যামেরার উত্থান সত্ত্বেও অ্যানালগ ফিল্ম ফটোগ্রাফির জনপ্রিয়তা কমেছে বলে মনে হয়নি। ২০০৪ সালে ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে আধিপত্য বিস্তার করলেও নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল ২০১১ সালের মধ্যে আবার ‘অ্যানালগ নবজাগরণ’ ঘটবে।

২০১৭ সালেও টাইম ম্যাগাজিন একই প্রত্যাবর্তনের কথা জানায়। 

২০২২ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল যে, মহামারির পর চাহিদা বাড়ায় ফিল্ম রোলের দাম বাড়ছে। এটি প্রমাণ করে অ্যানালগ ফিল্ম ফটোগ্রাফি কখনো পুরোপুরি বিদায় নেয়নি, বারবার ফিরে এসেছে এবং জনপ্রিয় রয়েছে। বারে বারে মনে হয়েছে একজন আলোকচিত্রীর কাছে ছবি তোলার বেলায় ফিল্ম নেগেটিভ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমরা যশস্বী নাসির আলী মামুনের সেরা ছবিগুলো যদি দেখি তাহলে বুঝতে পারব, ফিল্ম নেগেটিভের সাদাকালো ছবির কারুকাজ কতটা মায়াবী, কতটা শিল্পিত, কতটা হৃদয়স্পর্শী। তার পরও এখন ডিজিটাল দুনিয়ায় সব রঙিন। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল হাতে অজস্র মানুষ। সামাজিক মাধ্যম ভরা দুনিয়ার ছবি। তবু আমাদের উপজেলা সদরের ‘আলো-ছায়া’ স্টুডিও বা আনন্দ স্টুডিওর মজা ডিজিটাল জগতে মিলবে না। সেই রিলের ক্যামেরার দিন, ফটোগ্রাফারকে বারবার ছবির তাড়া দেওয়ার সেই স্মৃতি কোনো কালেও পুরনো হবে না।

এ ব্যাপারে মার্কিন ফটোগ্রাফার ওলেসেনের একটা বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ৫০ বছর পর হয়তো তার নাতি-নাতনির কাছে ডিজিটাল হার্ড ড্রাইভ বা সিডিতে সংরক্ষিত ছবিগুলো যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে নাও থাকতে পারে। কিন্তু তার শতাব্দী পুরনো নেগেটিভগুলো তখনো ব্যবহারযোগ্য থাকবে। রিল ক্যামেরার সেই সুখ কোথাও নেই। কোথাও পাওয়া যাবে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh