আশিক বিন রহিম
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:২৫ পিএম
প্রতীকী ছবি
এক
সাহিত্যের সরল সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাহিত্য মানে হিতের সহিত’। স্বল্প কথায় যার অর্থ দাঁড়ায় ভালো অথবা মঙ্গলের সাথে। বহুকাল ধরে ‘হিতের সহিত’ চর্চিত চাঁদপুরের শিল্প-সাহিত্য। বর্তমানে শিল্প-সাহিত্য চর্চায় দেশের অন্যতম আদুরে নামটি নদীবিধৌত চাঁদপুর জেলা। জল-শস্য আর কাদামাটির লাবন্যে লালিত এ জেলার মানুষের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস বহুদিনের।
এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য নাম মধ্যযুগের কবি এবং পুঁথি সাহিত্যির অন্যতম পুরোধা দোনা গাজী। যিনি মহাকবি আলাওলের বহু বছর পূর্বে ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল’ নামে কাব্য রচনা করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিখ্যাত ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, রবীন্দ্রনাথের অন্যতম সহকারী কালীমোহন ঘোষ, উপমহাদেশের বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ শান্তিদেব ষোঘ, বহুলপাঠিত ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থের স্রষ্টা যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়), দুই বাংলার প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ, দেশের প্রথম নজরুল গবেষক এবং জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী হাসেম খান, মনিরুল ইসলাম, বরেণ্য লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, চাঁদপুরের কৃতি সন্তান। এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্রশিল্পী চিত্রনিভা চৌধুরী, প্রথম নারী সাংবাদিক নূরজাহান বেগম, দেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর অন্যতম অভিনেত্রী এবং ভাষা সৈনিক জহরত আরা খুক, নারীদের মধ্যে প্রথম একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী ড. ফরিদা জামান, কিংবদন্তি নায়িকা অঞ্জনা রহমান চাঁদপুরের গর্বিত সন্তান। এজনই বাধকরি- কবি ইদ্রিস মজুমদার স্বল্প কথায় চাঁদপুরের স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন- ‘চাঁদপুর ভরপুর জলে আর স্থলে/ মাটির মানুষ আর সোনার ফলে’।
অগ্রজদের সুবর্ণ পথ ধরে আজও এগিয়ে চলছে চাঁদপুরের সাহিত্যি তরী। এ জেলার শব্দশিল্পীরা সাহিত্যকর্মের দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন গোটা বাংলাদেশে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চাঁদপুরে থেকে এখানকার সাহিত্য আন্দোলনকে বেগবান করতে যাঁরা নানানভাবে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম, অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদার, অজিত কুমার মুকুল, মাহমুদুল বাসার, ফেরদৌস মোবারক, হরিপদ চন্দ, স্বপন রক্ষিত, প্রফেসর মনোহর আলী, প্রকৌ. দেলোয়ার হোসেন, মোখলেসুর রহমান মুকুল ও পীযূষ কান্তি রায় চৌধুরী। এছাড়াও অগ্রজদের কাতারে দাঁড়িয়ে এখনো যারা তরুণ সাহিত্যকর্মীদের উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন তারা হলেন, অজয় ভৌমিক, জীবন কানাই চক্রবর্তী, কাজী শাহাদাত, ফতেউল বারী রাজা, আইনুন নাহার কাদরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমকালীন সাহিত্যে চাঁদপুরের অসংখ্য লেখক তাঁদের স্বকীয়তা এবং নিজস্বতা জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেখ ফিরোজ আমদে বাবু, ড. সরকার আবদুল মান্নান, হুমায়ুন কবির ঢালি, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, নাসিমা আনিস, কবির বকুল, জামসেদ ওয়াজেদ, মনসুর আজিজ. ইলিয়াস ফারুকী, প্রণব মজুমদার, মিজান খান, আহমেদ রিয়াজ, পীযুষ কান্তি বড়ুয়া, মেহেরুন্নেছা, সৌম্য সালেক, শাহ বুলবুল, শামসুল আরেফিন, হাশেম খান, হাসান মোস্তফিজুর রহমান, তারিক টুকু, গোলাম নবী পান্না, আফসার নিজাম, মেহেদী উল্লাহ, জাহাঙ্গীর হোসেন, শাহাদাত হোসেন শান্ত, আবদুল্লাহিল কাফী, নিলুফা আক্তার শিল্পী, গাজী মুনছুর আজিজ, মাইনুল ইসলাম মানিক, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, কাদের পলাশ, নুরুল ইসলাম ফরহাদ, ম. নূরে আলম পাটওয়ারী, দন্ত্যন ইসলাম, কিশোর মাহমুদ, জাবেদ ইমন, শহমুব জুয়েল, মোস্তফা হামেদী, আশিক বিন রহিম, সুজন আরিফ, সাদমান শরীফ, রফিকুজ্জামান রণি, নিঝুম খান সহ আরো অনেকে।
দুই
লিটলম্যাগ কিংবা ছোটকাগজ- আদুরে যে নামেই ডাকি না কেনো, সময়ের সাহিত্য পাড়ায় এর প্রধান ভূমিকা লেখক সৃষ্টির আঁতুরঘর হিসেবে। নবীন-প্রবীণ লেখকদের মাঝে মেলবন্ধন সৃষ্টির পাশাপাশি সাহিত্য এবং সামাজিক আন্দলনেও লিটলম্যাগ বিশেষ অবদান রাখছে। লিটলম্যাগ সৃষ্টিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক ভাবনার স্বাতন্ত্র স্তম্ভ। যা প্রচলিত ও গতানুগতিক সাহিত্যচর্চার বাইরে নতুন চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে। বানিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লিটলম্যাগের জন্ম এবং পথচলা। বাংলাদেশে লিটলম্যাগ আন্দোলনের ইতিহাস অনেক দিনের। এ আন্দোলন কেবলমাত্র রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীকই নয়, বরং এর স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রটিতি জেলা তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। এ আন্দোলনে পিছিয়ে নেই, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সমৃদ্ধভূমি চাঁদপুর। বর্তমানে লিটলম্যাগ আন্দোলন তথা সাহিত্য চর্চায় উচ্চারিত দেশের অন্যতম অদুরে নাম নদীবিধৌত চাঁদপুর জেলা। স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তীতে চাঁদপুর থেকে প্রায় পঞ্চাশটির অধিক ছোট কাগজ বা লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে চাঁদপুর থেকে মৃক্তিকা, তরী, চাষারু, ত্রিনদী, বাঁক, বর্ণিল, বক্ষবুলি, আঙন, অনপেক্ষ, জানালাসহ দশটি লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পূর্বে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগীতায় ’অন্যগ্রাম’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশকিছু দেয়াল পত্রিকা সাহিত্য আন্দোলন অনন্য ভূমিকা রাখে। ওই সময়ে ‘সুর্যের আলো’, দীপিকাসহ অনেকগুলো দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এরপর হারুন আর-রশিদের সম্পাদনায় ‘উঠোন’, ইলিয়ান পারভেজের সম্পাদনায় ‘জিগীষা’, ফেরদৌস মোবারক ও মহিবুল আহসানের সম্পাদনায় ’রানার’, নাজমুল আহসান নিজাম সম্পাদিত ‘জাগ্রত বাংলা’ ও ‘বিস্ফোরণ’সহ বেশ কিছু ছোট কাগজ প্রকাশিত হয়। আশি এবং নব্বই দশকে বৃহত্তর কুমিল্লার সাড়া জাগানো সাহিত্যপত্র ছিলো কাজী শাহাদাত সম্পাদিত ‘নির্ভীক’ ও ‘নির্ঝর’, জিয়া উদ্দিন বাবুল সম্পাদিত ‘তরঙ্গ’, আবুল হোসেন বাঙালির ‘এবং’, আবদুল্লাহিল কাফীর ‘অভিষেক, খিজির আহমেদ রনির ‘মুক্তাঙ্গন ও ‘কাব্যলোক, অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদারের সম্পাদিত ‘মোহনা’। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুরে সাহিত্য একাডেমী। যা সাহিত্য আন্দোলন ও লখক সৃষ্টিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।
তবে নানারকম সীমাবদ্ধতার কারণে সারা দেশের মত চাঁদপুরেও লিটলম্যাগ আন্দোলন কিছুটা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যার মধ্যে তিনটি কারণ মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়; (এক) বিজ্ঞাপন না পাওয়া, (২) রাষ্ট্রিয় পৃষ্টপোষকতা না থাকা, (৩) এ সাহিত্যপত্রটি টাকা দিয়ে কিনে পড়ার মত পাঠক তৈরী না হওয়া। তবুও এতকিছু বাধাকে মাড়িয়েই চলছে চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চা এবং লিটলম্যাগ আন্দোলন। একজন লিটলম্যাগ কর্মী বা সম্পাদক কেবলমাত্র সাহিত্যকে ভালোবেসেই বছরের পর বছর ধরে নিজের পকেটের টাকা খরচা করে এ সাহিত্যপত্রটি প্রকাশ করে আসছেন। সম্প্রতিক সময় চাঁদপুর থেকে ‘নতুন উদ্যমে প্রকাশিত’ লিটলম্যাগের সর্বাধিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে কবিতার কাগজ তরী’। কবি ও গল্পকার আশিক বিন রহিমের সম্পাদনায় এই ছোটকাগজটির ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কবি ও প্রাবন্ধিক সৌম্য সালেকের সম্পাদনায় চাষারু, কবি ও গল্পকার কাদের পলাশের সম্পাদনায় ত্রিনদী, কবি ও গল্পকার মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের সম্পাদনায় মৃত্তিকা ও বাঁক, কবি ও গল্পকার শাহমুব জুয়েলের সম্পাদনায় বর্ণিল, কবি জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পাদিত বক্ষবুলি, কবি ম. নূরে আলম সম্পাদিত আঙন এবং কবির হোসেন মিজি সম্পাদিত জানালা সাহিত্যপাড়ায় প্রশংসা কুড়াচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগগুলো হলো : তরঙ্গ, অভিষেক, মুক্তাঙ্গন, কাব্যলোক, ঢেউ, ডাকাতিয়ার বাঁকে, কলম সৈনিক, কালের কলম, উপমা, বিহঙ্গ, আয়না, নবীন প্রতিভা, সাহিত্য সময়, লালন, সাহিত্য দর্পণ, বনলতা, অনপেক্ষ, শেকড়, ভাজপত্র সুঁইসহ আরো অনেক ছোট কাগজ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর লেখক পরিষদ, ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম, সাহিত্য মঞ্চ, চর্যাপদ একাডেমি, কবিতাঙ্গণ, চাঁদপুর সাহিত্য পরিষদসহ বেশকিছু সংগঠন এখানকার সাহিত্য চর্চায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
তথ্যসূত্র :
১. ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, চাঁদপুর’। বাংলা একাডেমি: প্রকাশকাল ২০১৮।
২. কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, প্রকাশকাল ১৯৮৪।
৩. চাঁদপুর পরিক্রমা, লেখক পিয়তোষ সাহা, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১৬।
৪. চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের তথ্য বাতায়ন।
৫. চাঁদপুরের চাঁদমুখ; আশিক বিন রহিম, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০২২।