আফসান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০১ পিএম
আফসান চৌধুরী। ফাইল ছবি
আমরা যে একটা গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র তার প্রমাণ আমাদের জীবনে এই সব গণঘটনার বাস্তব উপস্থিতি থেকেই বোঝা যায়। ইদানীং গণপিটুনি সবার বেশ নজরে এসেছে, বিশেষ করে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে গণপিটুনিতে দুই লোকের মৃত্যুর পর। তবে মানুষ এত আশ্চর্য হচ্ছে কেন? এটা আমাদের দীর্ঘদিনের চর্চা। আমরা অনেক কিছুই তো গণভাবে করি, তাহলে এটা নয় কেন? পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে বলে? মৃত্যু তো এই দেশে ডাল-ভাত। নাকি জনৈক মানসিক ভারসাম্যহীন লোককে খাইয়ে দিয়ে তারপর পিটিয়ে মারাটা একটু বেশি হয়ে গেছে বলে কারও কারও মনে হচ্ছে? জাহাঙ্গীরনগরের তো ছাত্রলীগ কর্মী অতএব প্রায় হালাল হয়ে যায়। এই গণপিটুনির খবর এখন মিডিয়ায় নিয়মিত, কিন্তু এটা ছিল জন্ম থেকে। চলবে... এটা চলবেই।
দুই
একাত্তরের পরে এটা বেশ দেখা যেত। প্রথম প্রথম পাক আর্মির সমর্থক লোকদের মারা হয়েছে এভাবে। তখন দেশে কোনো আইন-শৃঙ্খলা ছিল না। যে যা খুশি করেছে। কিন্তু পরে এটা বেশ শত্রু খতম করার সুবিধাজনক পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ লেলিয়ে দিয়ে ডাকাডাকি করলেই পিটাবার লোক পাওয়া যেত। অনেক ঘটেছে। আমার মনে হয় মানুষ এভাবে নিরাপদে থেকে সবাই মিলে এক দুইজনকে পিটিয়ে মারতে যথেষ্ট আনন্দ লাভ করে। চিটাগং থেকে যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে গান গেয়ে গেয়ে সবাই একজনকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলছে। এটা বিনোদনের উপাদানও বটে সেটা পরিষ্কার।
তিন
১৯৭১-এর যুদ্ধের পর পর ছোট বড় চুরি-ডাকাতি অনেক বেড়ে যায়। ছিনতাই থেকে গাড়ি চুরি। এ থেকে নাম এলো ‘হাইজ্যাকের’, বেশ ভয়প্রদ। এরপর যে কোনো ঠেক দেওয়ার কাজকেই হাইজ্যাক বলা হতো। একবার যদি লোকে শব্দটা শুনত তাহলে আর রক্ষা নেই। যার দিকে আঙুল উঠত তার জানাজা পড়ার দ্রুত ব্যবস্থা করাটাই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। অর্থাৎ ডাক দিলেই হলো, অপরাধ প্রমাণের দরকার নেই, শুরু হবে গণপিটুনি। সবাই আমরা দেখেছি। হাইজ্যাকার মারা সমাজের চোখে অপরাধ ছিল না, তাই এত সুবিধাজনক ডাকনাম ছিল এটা। আমার ‘বেঁচে থাকার শব্দ’ উপন্যাসটি শুরু হয় এ রকম এক ঘটনার বিবরণ দিয়ে। অন্যটি এসেছে ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ উপন্যাসে, যেখানে একজন রাজনৈতিক শত্রুকে এভাবে ডাক দিয়ে হত্যা করা হয়। একজন অচেনা মানুষকে গণভাবে মারাটা যে কী জনপ্রিয় তা বলার নয়। গণপিটুনি বড়ই গণপ্রিয় বিষয়।
চার
মতিঝিলে এ রকম এক ঘটনার সাক্ষী আমি। গাড়ির টায়ার খুলতে গিয়ে দুই চোর ধরা পড়ে। ওরা চোর, অতএব মারাটা হালাল। কিন্তু এটা যে বিনোদন সেটা বুঝলাম যখন দেখলাম লোকজন রিকশায় যেতে যেতে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করছে, কী ঘটনা। যখন শুনছে ‘হাইজ্যাকার’ তখন নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা দুজনের দেহের ওপর নৃত্য করে সাধ মিটিয়ে হাসি মুখে চলে যাচ্ছে। মরার পরও চলেছে মার। ওই পুলক বিরিয়ানি খেলে ভেসে ওঠে হয়তো মানুষের মুখে। আসলে গণপিটুনিতে অংশগ্রহণ খুবই জনপ্রিয় একটি বিষয়। সব সময় সুযোগ, পরিবেশ থাকে না। ইদানীং কিছুদিন আছে, তাই হচ্ছে। আমরা গণহারে অনেক কিছুই করতে পছন্দ করি, এটা তারই অংশ। আমাদের রক্তের, মনের অংশ, হয়তো সবার আছে এই ইচ্ছা। সুযোগ পাই না।
পাঁচ
অনেকে বলছেন যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও যথেষ্ট সবল নয় তাই এটা ঘটছে। কথাটা ঠিক, কিন্তু গত দশ বছরে এ রকম ঘটনা বেশ কয়েকটা হয়েছে। ইটের ভাটায় কয়েকটি যুবককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এর বিচারও হয়েছে। এক মহিলাকে কয়েক বছর আগে ‘ছেলেধরা’ বলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গ্রামের দিকে ডাকাত ধরা পড়লে কী হয় সেটা বলার দরকার নেই। তাই আইন পরিস্থিতির কারণে হচ্ছে- এটা ঠিক। কিন্তু কখনোই থামে না এটা, কমে মাঝে মাঝে। যেমন এনকাউন্টার কিলিং করে রাষ্ট্রিক শক্তি, তেমনি গণপিটুনি হচ্ছে তার সামাজিক প্রকাশ। হত্যাকারী ও হত্যা দুটোই বাস্তবতা।
ছয়
ছাত্রলীগের নেতার প্রতি রাগ ছিল অনেকের। কিন্তু তোফাজ্জল পাগলের দোষটা কোথায়? লক্ষ্মীপুরের এক আওয়ামী লীগ কর্মীর প্রতি ক্ষোভ ছিল। কিন্তু চিটাগংয়ের এই যুবক যাকে, ঝুলিয়ে মারা হলো গণভাবে গান গেয়ে- ভিডিও ভাইরাল; সে ছিল লেবারই। তার মানে বড়জোর চোর। বিষয়টা গণপিটুনি অপরাধ নয়, মনে কি হয় না এটা এক ধরনের আনন্দ সংগ্রহের উপাদান ছিল সবার জন্য? বিষয়টা আমরা মানতে পারছি না।
হত্যা না হয় খুব এক্সট্রিম কিছু, কিন্তু ফেসবুকে গণগালি করে কেন মানুষজন? গণপিটুনির মৌখিক প্রকাশ তার মধ্যে। সবচেয়ে জঘন্য ভাষায় মানুষ তাই করে। কেন করে? অচেনা মানুষকেও করে। তার কোনো তথ্য যাচাইয়ের দরকার নেই, গালিগালাজের সুযোগটাই আসল, সবাই মিলে একসঙ্গে। অতএব এটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং গণপিটুনি গণগালির যে মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আছে সেটাই বোঝা দরকার।
সাত
আমাদের এখানে নিয়মিতভাবে গণধর্ষণ এবং প্রচুর কেস পর্যন্ত হয়। তাতে কিন্তু জাতি এত মাইন্ড করে না। চলবেই ভেবে নেয়, মেনে নেয়। গণচুরি তো হচ্ছেই, নয়া মধ্যবিত্তের বিত্তের ভিত্তি। তাই অনেকের অংশগ্রহণের আগ্রহ আছে জানা যায়। গণবিয়ের কথাও শোনা গেল, যদিও বিষয়টা কী তা জানি না। আসল কথা আমরা অনেক কিছু গণভাবে করতে চাই, যা একলা করার সুযোগ বা পরিস্থিতি সব সময় থাকে না; কিন্তু পেলে কাজে লাগাই। তাই সবাই মিলে তথাকথিত ‘নিষিদ্ধ’ কাজ করি। গণপিটুনিতে যে পুলক অনুভব করা যায় সেটা অন্য গণকাজে কম। আমরা সবাই এটা করতে চাই। ওই রকম পিটুনিদাতা মবের মধ্যে নিজের চেহারা খোঁজার চেষ্টা করলে দেখতে পাব। ওটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ওটাই আমরা।