দীপংকর গৌতম
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩২ এএম | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম
ডেঙ্গু রোগ বিস্তারের চিত্র।
সারা বিশ্ব এখন যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রকেট, বিমান হামলা, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ চলছেই। মারা যাচ্ছে মানুষ, কুঁকড়ে উঠছে মানবতা। ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, লেবানন, ইউক্রেন- সবখানে মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছেই। আমাদের দেশ বিশ্বের ওই সব যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তুলনায় ভালো থাকলেও এখানে অশান্তির ভয়ানক কারণ হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। ঘরে ঘরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে গেলে যে কোনো লোকের চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যাবে। সব ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী যেন উপচে পড়ছে। ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালের ওয়ার্ড জুড়ে মশারি টাঙানো। তার মধ্যে শুয়ে কাতরাচ্ছে রোগী। অনুচক্রিকা (প্লাটিলেট) কমে যাওয়ায় স্বজনরা ছুটছে রক্তের খোঁজে। এরই মধ্যে আসছে নতুন রোগী। হাসপাতালের ওয়ার্ডে বাড়ছে ব্যস্ততা।
বেসরকারি হাসপাতাল হেলথ অ্যান্ড হোপের রিসিপশনে কথা বলে জানা গেল, রোগী রাখার জায়গা নেই। একই অবস্থা বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর। শুধু এডিস মশা নিধনে সময়মতো গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি ভয়ংকরের দিকে মোড় নিয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। মৃত্যুর হিসাব দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসের ১২ দিনে ডেঙ্গুতে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছর মৃত্যু হলো মোট ২১০ জনের। এটা যুদ্ধাবস্থার চেয়ে কম কিসের? আক্রান্ত হাজার হাজার। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের যে অর্থনৈতিক সংকট তাতে টেস্ট করানোর ক্ষমতা নেই। হাটে-বাজারে ওষুধের দোকানে বাড়তি মূল্য দিয়ে টেস্ট করানোর সঙ্গতি কজনের আছে? তার মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্তহীন দুর্ভোগে মানুষ। এর মধ্যে পরিবারের কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়ার ঝক্কি, অর্থনৈতিক সংকট- সব মিলিয়ে টেস্টমুখো হতে চায় না কেউ। ফলে প্লাটিলেট কমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রোগী। বিশেষত মফস্বলে এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বেশি মানুষ। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দুই মাস আগেই সতর্ক করেছিলেন যে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের পরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এ চিত্র ঢাকা মহানগরীর। কিন্তু ডেঙ্গু শুধু রাজধানীর অলিগলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে- ঘটনাটা এমন নয়। ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে এখন মফস্বলেও।
জেলা-উপজেলা শহরেও নগরায়ণ হচ্ছে, কিন্তু পানি সরবরাহ না থাকায় মানুষ বাসাবাড়িতে ড্রামে বালতি বা অন্যান্য পাত্রে পানি জমিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সেখানে এডিস মশার প্রজনন ঘটছে। যার কারণে ডেঙ্গু এখন আর শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক নেই, ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল অবধি। এর থেকে নিরাময়ের জন্য দরকার ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যেমন তেমন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ বলতে দেশে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। শহর থেকে গ্রাম সবখানে ভয়ংকর আকার নিয়েছে ডেঙ্গু। মফস্বলে ডেঙ্গু শনাক্ত না করে জ্বর সামলাতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরের।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছরই ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন তারা এটাকে চাকরি হিসেবে দেখছে, সেবা ও ভালোবাসার আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপস্থিতিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ। গত ১২ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি। ১৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (১২ অক্টোবর সকাল আটটা থেকে ১৩ অক্টোবর সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গু নিয়ে ৯১৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫ জন, বরিশালে ২ জন, ঢাকা উত্তর সিটি ও চট্টগ্রাম বিভাগে আরও একজন করে দুজন মারা গেছে। ২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২১০ জনের। গত বছর (২০২২) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ৭০৫ জনের। এত মৃত্যুর পরও বিষয়টি যেন সবার গা সওয়া বিষয় হয়ে গেছে। নতুবা চলতি বছরে ২১০ জনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একই সঙ্গে জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ৪১ হাজার ৮১০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। এরপরও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বিস্মিত হতে হয়। দুটো সিটি কর্পোরেশন থাকার পরও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আমরা সবচেয়ে যে বিষয়টি লক্ষ করেছি সেটা হলো, মানুষের মৃত্যু নিয়ে কারও কিছু যায় আসে না। যে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ২১০ জন বেসামরিক মানুষ হত্যায় বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের খবরে বড় অংশ নিয়ে নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে এডিস মশার হুল ফোটানোর কারণে মানুষের এই মৃত্যু, কয়েক হাজার হাসপাতালে কাতরাচ্ছে, বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে অজস্র মানুষ, তারপরও কর্তৃপক্ষের কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হচ্ছে না। যেন সহজ একটি ঘটনা। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে যে সচেতনতা তাও কোথাও নেই, নেই সরকারি প্রচারও। আর কত মৃত্যু দেখলে আমরা সচেতন হব?
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুই সিটি কর্পোরেশন কি পদক্ষেপ নিয়েছে? কোনো পদক্ষেপ কারও চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু বৈচিত্র্য হারাচ্ছে। যে কারণে শরৎকাল শেষ হয়ে এলেও বর্ষাকালের মতো বৃষ্টি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে বন্যা। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ডেঙ্গু। রোগীদের ঠাঁই মিলছে না হাসপাতালে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনও কি কোনো ব্যবস্থা নেবে না?