স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৪ এএম
নরেন্দ্র মোদি ও জো বাইডেন। ছবি: সংগৃহীত
ভারত এর আগে কখনো কোনো পশ্চিমা দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যুদ্ধ লড়েনি। এই মুহূর্তে কানাডা-ভারত এক উত্তপ্ত দ্বৈরথে অবতীর্ণ। কানাডার মতো এবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কূটনৈতিক যুদ্ধ হতে যাচ্ছে ভারতের। ইস্যু একই- খালিস্তানি নেতাদের হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্র। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ আমলে নিয়েই ভারত এগোবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী খালিস্তানপন্থি নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন হত্যার ষড়যন্ত্র মামলায় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে তলব করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আদালত। সেই সঙ্গে তলব করা হয়েছে ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইংয়ের (র) সাবেক প্রধান সামন্ত গোয়েল, এজেন্ট বিক্রম যাদব ও ভারতীয় ব্যবসায়ী নিখিল গুপ্তকে। ২১ দিনের মধ্যে তাদের এই সমনের জবাব পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ নিউইয়র্ক ডিস্ট্রিক্ট আদালত।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালত এই সমন জারি করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঠিক আগে। এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে মোদির দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। সেখানে পান্নুন প্রসঙ্গ উঠবে কিনা, সে বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব নিশ্চিতভাবে কিছু না জানালেও মনে করা হচ্ছে, সে দেশে খালিস্তানপন্থি ‘উপদ্রবের’ বিষয়টি আলোচিত হবে। সফরের ঠিক আগে আদালতের সমন জারি তাৎপর্যপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারী সংস্থা এফবিআই আদালতে দাবি করেছে, ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ‘শিখ ফর জাস্টিস’ (এসএফজে)-এর নেতা পান্নুনকে হত্যার চেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন ভারত সরকারের সাবেক কর্মকর্তা বিকাশ যাদব এবং তার সঙ্গী নিখিল গুপ্ত। বিকাশ আদতে ‘র’-এর এজেন্ট বলেও দাবি করে তাকে
‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ঘোষণা করেছে এফবিআই। যদিও পান্নুনকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে মোদি সরকার। ঠিক যেমনটা তারা করেছিল কানাডায় খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের খুনের ঘটনায় ‘র’-এর ভূমিকা নিয়ে জাস্টিন ট্রুডো সরকারের অভিযোগ প্রসঙ্গে।
মার্কিন অ্যাটর্নি অফিস জানায়, খালিস্তানি নেতাকে হত্যার জন্য এক লাখ মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়। অগ্রিম বাবদ আততায়ীকে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হয়। তবে সেই ‘আততায়ী’ আদতে মার্কিন প্রশাসনেরই ‘আন্ডার কভার এজেন্ট’ ছিলেন। এরপরই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয় মার্কিন প্রশাসন। ওয়াশিংটনের অনুরোধে গত বছরের জুন মাসে চেক প্রজাতন্ত্র গ্রেপ্তার করেছিল নিখিলকে। পরে প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ এনেছে কানাডাও। সেখানে গত বছর খুন হন হরদীপ সিং নিজ্জর নামের আরেক খালিস্তানি নেতা। কানাডা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারত সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করে আসছে। এ নিয়ে গত এক বছর ধরে কূটনৈতিক লড়াই চলছে ভারত ও কানাডার মধ্যে। গত ১৩ অক্টোবর কানাডা সরকার নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে দেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার সঞ্জয় কুমার ভার্মার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ আনে। ভারতকে পাঠানো বার্তায় কানাডা সঞ্জয়কে ‘স্বার্থ-সম্পর্কিত ব্যক্তি’ (পারসন অব ইন্টারেস্ট) বলে উল্লেখ করে। পরদিন কড়া ভাষায় তার জবাব দেয় ভারত। নির্বাহী হাইকমিশনার স্টুয়ার্ট রস উইলারকে ডেকে প্রতিবাদপত্র হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় ভারত বহিষ্কার করে কানাডা দূতাবাসের ছয় কূটনীতিককে, যাদের মধ্যে ছিলেন স্টুয়ার্টও।
এক বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি; কিন্তু এবার পাল্টাপাল্টি ছয়জন করে কূটনীতিক প্রত্যাহার, তদন্তের নিরিখে খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্ককে জটিলতর করে তুলেছে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) মনে করে, দুই দেশ সংযত না হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে তা শিগগিরই প্রভাব ফেলতে পারে। সংস্থাটির মতে, কূটনৈতিক সম্পর্কহানি সত্ত্বেও বাণিজ্যিক সম্পর্কে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি; কিন্তু সম্পর্ক শত্রুতার পর্যায়ে পৌঁছলে চিন্তা বাড়তে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, নিজ্জর হত্যা ও কূটনৈতিক সম্পর্কহানির প্রভাব অ-রাজনৈতিক সামাজিক স্তরে পড়তে পারে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খালিস্তান ইস্যু নিয়ে কূটনৈতিক লড়াই ভারতের জন্য অশনি সংকেত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।