সেন্টমার্টিন নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩ এএম

সেন্টমার্টিন দীপ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

সেন্টমার্টিন দীপ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

দীর্ঘ ৯ মাস পরে পর্যটকের পা পড়ল ভ্রমণপিয়াসী মানুষের অন্যতম প্রধান গন্তব্য সেন্টমার্টিনে। পয়লা ডিসেম্বর সকালে ৬৫৩ জন যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ‘বারো আউলিয়া’ নামক জাহাজটি। তবে এর মধ্য দিয়ে সেন্টমার্টিনে পুরোদমে পর্যটন শুরু হলো, তা বলার সুযোগ নেই। কেননা সেন্টমার্টিনে পর্যটন নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্প্রতি যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তা নিয়ে এখনো স্থানীয়  মানুষ এবং সেখানের পর্যটন ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। প্রশ্ন আছে সেন্টমার্টিন ঘিরে সরকারের দূরবর্তী পরিকল্পনা নিয়েও।

গত ৫ মার্চ থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। ৯ মাস পরে পয়লা ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে জাহাজটি ছেড়ে যায়। কেননা নাফ নদে ডুবোচর জেগে ওঠায় নাব্য সংকট এবং মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির কারণে নিরাপত্তার অভাবে টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ।

গত ২৮ নভেম্বর থেকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরুর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যাত্রী সংকটের কারণে নির্ধারিত ‘কেয়ারি সিন্দবাদ’ জাহাজটি ছেড়ে যায়নি। এর একটি বড় কারণ এখন থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে হলে যাত্রীকে সরকার নির্ধারিত অ্যাপে নিবন্ধন করতে হয়। অনেকেই নানা জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে নিবন্ধন করতে পারেননি। আর নিবন্ধন ছাড়া জাহাজে বুকিং দেওয়া সম্ভব হয়নি।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ১০টি টিম। তারা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজ মনিটরিং, স্ক্যানিংসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবে। জাহাজে পর্যটকদের বিনা মূল্যে পাটের তৈরি ব্যাগ দেওয়া হবে। যাতে কোনো পর্যটক পলিথিন ও ওয়ানটাইম প্লাস্টিক পরিবহন না করেন।

প্রসঙ্গত, আগে প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছয় মাস টেকনাফ-সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হতো। বাকি ছয় মাস সাগর উত্তাল থাকায় জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হতো।

কিন্তু সরকার সম্প্রতি সেন্টমার্টিনে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিয়ে যে আদেশ জারি করেছে, সেখানে বলা হয়েছে : ১. নভেম্বর মাসে পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন, কিন্তু রাত যাপন করা যাবে না। ২. ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে পর্যটকরা যেতে পারবেন এবং রাতেও থাকতে পারবেন, কিন্তু প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি নয়। ৩. ফেব্রুয়ারিতে সেন্টমার্টিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে পর্যটক যাওয়া বন্ধ থাকবে। তার মানে বাকি ৮ মাস পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ এবং জীবিকা নিয়ে চিন্তিত সেন্টমার্টিনের স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত মানুষ।

এ নিয়ে মোবাইল ফোনে কথা হয় সেন্টমার্টিনের কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে। সাংবাদিক আব্দুল মালেক জানান, দীর্ঘদিন পরে সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ ভেড়ার পরে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীদের অনেকেই তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। কেননা তারা বিশ্বাস করেন, পর্যটকরা তাদের অতিথি এবং তাদের কারণেই এই দ্বীপের হাজার হাজার মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। বিশেষ করে হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসায়ী, রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়ী ও কর্মী, অটোরিকশা চালক, ডাব বিক্রেতা, ক্ষুদ্র দোকানদাররা। কিন্তু বছরে মাত্র দুই মাস এখানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক থাকতে পারবেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে তারা ক্ষুব্ধ। তারা সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায়।

সেন্টমার্টিনের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমরা পর্যটকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছি, তার অর্থ এই নয় যে, আমরা আন্দোলন থেকে সরে এসেছি। বরং আমরা আমাদের দাবিতে অনড়। সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না সেন্টমার্টিনে পর্যটন নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ তিনি জানান, তারা এক সপ্তাহ দেখতে চান সরকার সেন্টমার্টিনের পর্যটন নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কি না। না এলে এখানের ব্যবসায়ীরা পুনরায় আন্দোলনে নামবেন।

হোটেল ব্যবসায়ী জালাল আহমেদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড়শ লোক কাজ করেন। পর্যটন বন্ধ হয়ে গেলে এই দেড়শ পরিবার কী খাবে, তা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তিনি মনে করেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারির সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসও যদি পর্যটকদের জন্য সেন্টমার্টিন উন্মুক্ত রাখা হয় এবং প্রতিদিন অন্তত তিন হাজার পর্যটকের রাত যাপনের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলেও কিছুটা পোষানো যাবে। অন্যথায় অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে যাবেন। বাধ্য হয়ে তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ অনেকেই বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন না।

আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, সেন্টমার্টিনে মার্কিন নৌবাহিনীর ঘাঁটি হবে বলে যে প্রচার রয়েছে, তারা সেটি বিশ্বাস না করলেও এই দ্বীপ এবং আশপাশে বঙ্গোপসাগরের এলাকা নিয়ে সরকারের দূরবর্তী কোনো পরিকল্পনা আছে কি না এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার নানা কৌশলে দ্বীপটি জনশূন্য করতে চায় কি না, তাদের মনে সেই প্রশ্ন আছে।

যদিও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের দাবি, সেন্টমার্টিন নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে বলা হয়েছে যে এখানে ঘাঁটি করার কোনো সুযোগ নেই, আয়তনও নেই। এটার গঠন হচ্ছে প্রবাল, এখানে কীভাবে ঘাঁটি হবে? মার্কিন দূতাবাস থেকে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে এমন কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি, কথাও হয়নি। প্রশ্ন হলো, কীভাবে সেন্টমার্টিনকে বাঁচানো যাবে? সেন্টমার্টিনকে বাঁচানো গেলে এলাকার মানুষকে বাঁচানো যাবে, শিল্প বাঁচবে, পর্যটনও বাঁচবে।

সরকার ও পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে সেন্টমার্টিনে উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কচ্ছপের আবাস ধ্বংস, প্লাস্টিকের ব্যবহার, মিঠাপানির সংকট, জোয়ারে সমুদ্র ভাঙনসহ নানা বিপদ দেখা দিয়েছে।

কিন্তু পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সেন্টমার্টিনের স্থানীয় অধিবাসীদের প্রায় শতভাগ মানুষ এবং দেশের প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটন ব্যবসায়ী সেন্টমার্টিনের ওপর নির্ভরশীল। বছরের চার থেকে পাঁচ মাস পর্যটন চালু থাকলেও সেই আয় দিয়ে তাদের পুরো বছর চলা যেখানে কঠিন, সেখানে আরো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দেবেন। এমনকি স্থানীয় মানুষের অনেকেই পেশা বদল করার জন্য শহরে চলে যাবেন। অর্থাৎ এক ধরনের বাস্তুচ্যুতি ঘটবে।

বাস্তবতা হলো, নভেম্বর মাসে যদি সেন্টমার্টিনে গিয়ে রাতে থাকা না যায় তাহলে এখানে এই মাসে কেউ যেতে আগ্রহ দেখাবে না। তার মানে নভেম্বর মাসে কোনো পর্যটকই সেন্টমার্টিনে যাবে না। বাকি দুই মাসও প্রতিদিন যেতে পারবেন মাত্র দুই হাজার পর্যটক। পর্যটননির্ভর মানুষ মাত্র- দুই মাসের আয় দিয়ে বছরের বাকি ১০ মাস কীভাবে সংসার চালাবেন, সেটি বিরাট প্রশ্ন।

তাহলে করণীয় কী? স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটন ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সেন্টমার্টিনের বিষয়ে সরকারের মূল উদ্বেগ যদি হয় পরিবেশ, তার জন্য বছরের ১০ মাস সেখানে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সমাধান নয়। বরং সেখানে ব্যবস্থাটিই এমন করতে হবে যে কেউ চাইলেই পলিথিন বা প্লাস্টিক নিয়ে যেতে পারবেন না। কোনো ধরনের ময়লা ফেললেই উচ্চ হারে জরিমানা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের জন্য সংশ্লিষ্টদের সততা ও আন্তরিকতা।

মানুষ যদি দ্বীপের কোনো ক্ষতি না করে সেখানে ভ্রমণ করতে পারে এবং সারা বছরই কমবেশি পর্যটনের মাধ্যমে দ্বীপের মানুষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে, তাতে সরকারের আপত্তি কেন? সরকার এখানে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করতে পারে। ব্যবসার জন্য বহিরাগতদের সুযোগ সীমিত করে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিতে পারে। সে জন্য একটি নীতিমালা করতে পারে। কিন্তু বছরের ১০ মাসই সেখানে পর্যটন বন্ধ থাকবে, এটি কোনো কাজের কথা নয়। বরং পরিবেশ সুরক্ষা তথা দ্বীপের বৈশিষ্ট্য ও প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচিয়ে কীভাবে সারা বছর সেন্টমার্টিনের পর্যটন চালু রাখা যায়, সেই ব্যবস্থা করা দরকার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh