এহতেশাম শোভন
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৮ এএম
বিস্তীর্ণ সমুদ্রের প্রাকৃতিক সম্পদ। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমি খাত সম্ভাবনার এক বিশাল ক্ষেত্র। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা এবং একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশ ব্লু ইকোনমির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বিদ্যমান। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি উৎপাদন এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বেলজিয়ামের অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে প্রথম ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণা দেন। তিনি তার ‘দ্য ব্লু ইকোনমি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ব্লু ইকোনমি হলো অর্থনীতির এমন একটি বিষয়, যেখানে একটি দেশের সামুদ্রিক পরিবেশ কিংবা সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর আরেক নাম ‘সুনীল অর্থনীতি’। একে ‘সমুদ্র অর্থনীতি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়।
সুনীল অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। এটি এমন এক উপকারী খাত হিসেবে বিবেচিত, যার মাধ্যমে একটি অঞ্চল বা দেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য মহাসাগরীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহারকে বোঝায়। এতে মৎস্য আহরণ, সমুদ্র পর্যটন, জাহাজ চলাচল, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন এবং সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদ আহরণ অন্তর্ভুক্ত।
প্রতি বছর বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। বিশ্বে ১০-১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকার জন্য সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৩০ শতাংশ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। বাণিজ্যিক পরিবহনের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। ইউরোপের উপকূলীয় দেশগুলো অর্থনীতি থেকে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো আয় করে, যা তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। প্রতি বছর সমুদ্রপথে ১৫০টিরও বেশি দেশের প্রায় ৫০ হাজারের ওপর বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে।
বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমি বলতে বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্পদকে বোঝায়। ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের ১২টি এবং ভারতের কাছ থেকে দাবীকৃত ১০টি ব্লকের সব পায় বাংলাদেশ। দুই বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত এ রায় দুটিকে প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ‘সমুদ্র বিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। ফলে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা এবং প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। সমুদ্রসম্পদের যথাযথ ব্যবহারে জাতীয় অর্থনীতিতে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমুদ্র বিশ্লেষকরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বজায় রেখে সমুদ্রে সম্পদের টেকসই ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নত জীবিকা কর্মসংস্থানের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক সম্পদের ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন লাভবান হচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশের কিছু ব্লু ইকোনমির সম্পদ ও গড় আয় দেখি, তাহলে মোটামুটি ধারণা করতে পারব কী পরিমাণ বিপুল সম্পদ এখান থেকে আহরণ করা হচ্ছে। জলজ পালন ছাড়াও তেল, গ্যাস ও খনিজ খনন অর্থনৈতিকভাবে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে মাত্র এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট অফশোর এলাকায় পাওয়া গেছে। সেখান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হচ্ছে, যা জিডিপিতে অবদান রাখছে।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র, যেখানে শিপিং ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং সুন্দরবন আন্তর্জাতিক পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় স্থান, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি শুধু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই নয়, বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সঠিক নীতি ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ খাত দেশের উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
ব্লু ইকোনমির অগ্রযাত্রা আমাদের তরুণ সমাজের জন্য একটা আশীর্বাদ। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় যেসব অনাবিষ্কৃত সম্পদ আছে সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব সংগ্রহ এবং টেকসই বাজার নিশ্চিত করতে হবে।
তবে ব্লু ইকোনমির উন্নয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, কার্যকর নীতি ও আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি, সঠিক কর্ম পরিকল্পনার অভাব, পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব, এবং জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাবসহ মেরিন রিসোর্স গবেষণা না হওয়া, ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাব এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজ না থাকাও অন্যতম।
এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নির্ভরযোগ্য তথ্য ও সঠিক পরিসংখ্যান সরবরাহ, গবেষণা ও উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং পরিবেশবান্ধব সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হবে।