দাম্পত্য যেখানে আটকায়

মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী। একসময় যার সঙ্গে একবেলা দেখা না হলে, কথা না হলে মনটা উচাটন হতো, এখন দিব্যি তাকে না দেখেই সময় পার করা যায়। একসময় যার সঙ্গে কথার ফুলঝুরি শেষ হতো না, আজ তার সঙ্গেই বলার মতো কোনো কথা, স্বপ্ন বা স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায় না। একসময় যার একটু মনোযোগ, ভালোবাসা ছিল আরাধ্য, এখন সেই মানুষটাই বড্ড সাধারণ একজন। মানুষের সম্পর্কের এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। 

নারী-পুরুষ বা দাম্পত্য কিসে আটকায়
উত্তর খুব সহজ- মনোযোগে, প্রেমে, মমতায়, প্রশংসায়, মূল্যায়নে। শব্দগুলোর উচ্চারণ যতটা সহজ, ওজন কিন্তু ততটাই ভারী। দাম্পত্য সম্পর্কে কেন শেষ পর্যন্ত প্রেমটা আর থাকে না? কেন তার সঙ্গটা দিনে দিনে একটা অভ্যাস হয়ে যায়? কেন একটা সময় পর তাকে আর বিশেষ কেউ মনে হয় না? কেন একসময় যার ছোঁয়া পেলে, যার কথা ভাবলেও শরীর-মনে শিহরণ জাগত তাকেই অসহ্যবোধ হতে থাকে। এর উত্তর কিন্তু খুব কঠিন না। এই পৃথিবী সবকিছুতেই তার মনোযোগ, সততা, যত্ন চায়।

প্রেম বা ভালোবাসাও তার বাইরে নয়। প্রেম বা বিবাহপূর্ব সম্পর্কে যে মাদকতা, পাগলামি, মনোযোগ থাকে, বিয়ের পর তা অনেকটাই কমে যায়। হতে পারে দুজনই তখন স্বপ্নের দুনিয়া থেকে বাস্তবে পা রাখে। প্রাত্যহিক জীবনযাপনে কাটতে থাকে মুগ্ধতা, বাড়তে থাকে প্রত্যাশা, কমতে থাকে একজনের প্রতি আর একজনের দুর্নিবার আকর্ষণ। 

পরিচিত এক ছোট বোন বলছিল, একসময় স্বামীর প্রতি তীব্র শারীরিক টান বোধ করত; কিন্তু স্বামী তাকে উপেক্ষা, এমনকি অপমান পর্যন্ত করত। দিনের পর দিন তার এই উপেক্ষা তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ করে দেয়। সে নিজেকে আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিতে থাকে। একটা সময় পর তার সঙ্গী চাইলেও তার আর মন চাইত না। দিনের পর দিন অবহেলা আর উপেক্ষায় নষ্ট হতে থাকে ভালোবাসার মিষ্টতা, প্রেমের প্রখরতা।

আর এক বন্ধু বলেছিলেন, তাদের সম্পর্কে ঢুকে পড়েছিল স্বামীর বোন, মা! কথায় কথায় তার সঙ্গে তুলনা করা হতো। তার অভিযোগ ছিল, যতই যত্ন করে সে রান্না করুক বা ঘর গুছিয়ে রাখুক তাকে সবসময়ই তুলনায় হেয় করা হতো। একটা সময় সে রান্না বা ঘর গুছানোসহ অন্যান্য সাংসারিক কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার অনেক সময় নারীও তার স্বামীকে তুলনা করতে থাকে তার অন্য অনেকের সঙ্গে; যা স্বামীর অহংবোধে আঘাত করে। ফলে সেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দাম্পত্যে তুলনা করার প্রবণতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সঙ্গীর অবচেতন মনে সেই বিষয়গুলো গভীর ছাপ ফেলে। যা পরবর্তীকালে একজনের প্রতি অন্যজনের শ্রদ্ধাবোধেও আঘাত করে। কমতে থাকে দুজনের প্রতি দুজনের টান। তাই এই প্রবণতা কোনো দম্পতির মধ্যে থাকলে সেটা শুধরে নেওয়াই শ্রেয়। বিয়ের পর অনেকেই ভাই বা বাবার বাড়ির কারও সঙ্গে স্বামীকে তুলনা করতে থাকেন- অমুক তো স্ত্রীর ছবি প্রোফাইল পিকে রেখেছে আর তুমি তো আমাকে সামান্য মেনশন করো না। আবার স্বামী তার স্ত্রীকে বলে, জানো অমুক ভাবি দারুণ রাঁধে, তোমার রান্না তার মতো হয় না। এই বিষয়গুলো যদি খুব সামান্য মনে হয় তবে আপনি বোকার স্বর্গে আছেন!

এই ছোট বিষয়গুলো যদি উপেক্ষা করতে থাকেন একসময় এগুলোই ভালোবাসার ঘরে ছিদ্র করতে থাকবে। যেটা একসময় এত বড় হবে যে চাইলেও সেটা বন্ধ করতে পারবেন না। তাই দাম্পত্যে মধুরতা বজায় রাখতে চাইলে দুজন দুজনের প্রতি মুগ্ধতা ধরে রাখুন, শ্রদ্ধাবোধ অটুট রাখুন। প্রশংসা করুন স্বামী বা স্ত্রীর, তাকে মূল্যায়ন করুন। তাকে বুঝতে দিন আপনি তার জীবনে কতটা মূল্যবান। তাকে কারও সামনে তুলনা করবেন না। সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য একটি বড় অন্তরায় এটা। 

বিনিয়োগ না করলে কিছুই থাকবে না জীবনে-এটাই চরম সত্যি। আর সম্পর্কে বিনিয়োগ হলো প্রায়োরিটি, মনোযোগ, যত্নে। সেটা স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একতরফা কিছুই এই প্রকৃতি মেনে নেয় না। নারী আটকে যায় পুরুষের প্রশংসায় আর পুরুষ আটকে যায় নারীর যতেœ। বড্ড সহজ সমীকরণ। জটিলতার কিছু নেই। দুজন যখন দুজনের অনুভূতিকে ছুঁয়ে যাবেন, যখন দুজন দুজনের কাছে শ্রেষ্ঠবোধ করাবেন, তখন দাম্পত্য হবে সুখের, ভালোবাসার। পুরোটাই বিনিয়োগের সূত্র। যা বুনবেন সেটার ফসল পাবেন। অবহেলা করলে অবহেলা আর ভালোবাসলে ভালোবাসা। তবে ভালোবাসার অপর নাম দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ। এই দুটোর ভারসাম্য রেখেই ভালোবাসার ঘরটি বুনতে হয়।

দায়িত্ববোধ মানে দুজনের আবেগীয় অনুভূতির দায়িত্ব নেওয়া; নিছক অর্থনৈতিক বা পারিবারিক দায়িত্ববোধ না। বরং আবেগের বিষয়টি সম্পর্কের অনেক বড় একটি অংশ জুড়ে থাকে। তাই দুজনের আবেগ অনুভূতির জায়গায় দুজন শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সব সময়ই মেনে আর মানিয়ে চলার বাইরেও একটি আরামদায়ক জায়গা রাখতে হবে। যেখানে সে যেমন সেভাবেই যেন নিজেকে নির্ভার রাখতে পারে। মানিয়ে বা মেনে চলার চেয়ে বুঝতে পারা বা উপলব্ধি করা বেশি জরুরি। প্রেমের বাঁধন গলার ফাঁস না হয়ে যদি আশ্রয় হয়ে ওঠে তবেই দাম্পত্যে প্রেম নতুন নতুন রূপে ধরা দেবে। তাই নারী বা পুরুষ যেটাতে আটকে থাকে সেটা হলো প্রেম। তাই প্রেমকে ধরে রাখুন। জীবনচর্চায় ভালোবাসা প্রকাশ করুন সঙ্গীর কাছে। যেখানেই হোক ভালোবাসা প্রকাশে দ্বিধাহীন হোন। দাম্পত্য সুরক্ষিত থাকুক মমতায়, যত্নে, মনোযোগে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //