আত্মশুদ্ধির মাস রমজান

মাহে রমজানুল মোবারকের আজ ১৪তম দিন। মুমিন বান্দাদের আত্মশুদ্ধি ও মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধন এ মাসে সিয়াম পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য। আত্মশুদ্ধির সারবস্তু হলো তাকওয়া অর্জন ও পাপাচার বর্জন। 

রমজান মাসে সিয়াম পালনের পাশাপাশি এ দুটি দিকের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। এ মাসে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ রব্বুল আলামিন। আর উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার’।

ইরশাদ হয়েছে- হে মুমিন, তোমাদের ওপর সিয়াম পালন আবশ্যিক করা হলো, যেমন তা আবশ্যিক করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)

আয়াতে ব্যবহৃত ‘লাআল্লা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ-আশা করা যায়; কিন্তু কোরআন মজিদের বর্ণনাভঙ্গি আলঙ্কারিক। মাখলুকাতের আশা ও কামনা পূরণ হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই; কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার আশা অমোঘ। তিনি যা চাইবেন, তা-ই হবে। সুতরাং বর্ণনার সৌন্দর্য ও ভাষাশৈলীর সৌকর্য হিসেবে আশাব্যঞ্জক শব্দ ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সিয়াম পালনের ফলে তাকওয়া অর্জন যে অবশ্যম্ভাবি, তা-ই ইঙ্গিত করা হয়েছে এ আয়াতে।

কোরআন মজিদের সুরা হুজুরাতের ১৩নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে মানুষ, নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন নর ও একজন নারী থেকে এবং তোমাদের জাতি ও গোষ্ঠীসমূহে বিভক্ত করেছি এজন্য যে তোমরা পরস্পর পরিচিত হবে। নিশ্চয়ই তোমাদের মুত্তাকীই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত।

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদার মাপকাঠি তার তাকওয়া। যার চরিত্রে তাকওয়ার মাত্রা যেমন, আল্লাহ তায়ালার কাছে তার মর্যাদা তেমন। অতএব, একজন মুমিন বান্দার উচিত আল্লাহর নিকট মর্যাদা লাভের জন্য তাকওয়ার গুণ অর্জন ও তা উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

তাকওয়া শব্দের অর্থ সাবধানতা ও সংযম। মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকাই তাকওয়ার অর্থ বলে বর্ণনা করা হয়। তবে মন্দ কাজ বর্জন যেমন জরুরি, তেমনি ভালো কাজগুলো করাও তাকওয়ার অন্তর্গত। কর্তব্য পালন ও বর্জনীয় পরিহারের সমষ্টিই তাকওয়া।

সাধারণভাবে আকওয়া শব্দের অর্থ করা হয় আল্লাহর ভয়। মহান রাব্বুল আলামিনের সামনে একদিন সবাইকে হাজির হতে হবে। সেদিন দুনিয়াবী জীবনের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণের হিসেব দিতে হবে। এই বিশ্বাস ও ভয়ই মানুষকে সাবধানী ও সংযমী করে তোলে। 

ইসলামী শরীয়তে বান্দার করণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তেমনি এসবের গুরুত্ব ও মাত্রার পর্যায়ক্রম নির্নীত আছে। করণীয়গুলোকে আবশ্যিকতার মাত্রার পর্যায়ভেদ অনুযায়ী ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব পরিভাষায় প্রকাশ করা হয়। আর বর্জনীয়গুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় হারাম, মাকরুহ তাহরীমী, মাকরুহ তানজীহী ইত্যাদি পরিভাষা। কর্তব্য পালন ও বর্জনীয় পরিহারের মাত্রা অনুযায়ী তাকওয়ার স্তর বিন্যস্ত করা হয়। 

মুসলিম মনীষিরা তাকওয়ার তিনটি স্তর বর্ণনা করেন - প্রাথমিক, মধ্যম ও উচ্চ। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য যা অবশ্য পালনীয় অর্থাৎ ফরজ ও ওয়জিব, তা পালন করা এবং যা অবশ্য বর্জনীয় অর্থাৎ হারাম ও মাকরুহ তাহরীমী, তা বর্জন করা তাকওয়ার প্রাথমিক পর্যায়। অর্থাৎ তাকওয়ার প্রাথমিক ও ন্যূনতম পর্যায় হারাম ও মাকরুহ তাহরীমী বর্জন এবং ফরজ ও ওয়াজিব আদায় করা। কারো মধ্যে কমপক্ষে এতটুকু থাকলেও তিনি মুত্তাকী। বলা যায়, একজন মুমিনের জন্য তাকওয়ার এই স্তরটি আবশ্যিক। নিম্নতম এই তাকওয়া নাজাতের জন্যও শর্ত। ফরজ ও ওয়াজিবের পাশাপাশি সুন্নতসমূহ পালন এবং হারাম ও মাকরুহ তাহরীমীর পাশাপাশি মাকরুহ তানজীহ বর্জন তাকওয়ার মধ্যম স্তর। আর মুস্তাহাবগুলো পালন এবং সন্দেহজনক কাজসমূহও বর্জনে সচেষ্ট থাকা তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর।

আর পাপাচার বর্জনেই সিয়ামের পূর্ণতা সাধিত হয়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার ও কামাচার পরিহার করার নাম সিয়াম। এটাই সাধারণ অর্থ। কোনো মুসলমান যদি শুধু এতটুকু পালন করে তবুও তার ফরজ আদায় হয়ে যাবে; কিন্তু এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সিয়ামের তাৎপর্যের পরিপন্থী। শুধু দৈহিক চাহিদা পূরণ থেকে সংযমী হলে সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয় না। সিয়ামের পূর্ণতার জন্য পানাহার ও কামাচার বর্জনের পাশাপাশি পাপাচার থেকেও বিরত থাকতে হয়। এটাও সিয়ামের দাবি।

এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বরাতে একটি হাদিস সংকলন করেছেন ইমাম তিরমিজী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, রোজা রেখে যে ব্যক্তি মিথ্যাচার ও অন্যায় আচরণ পরিহার করল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ এমন রোজা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। সুতরাং পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনার পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে হলে অন্যায় কার্যকলাপ থেকেও বিরত থাকতে হবে। হাদীসটির আলোকে রোজার জন্য পানাহারের সঙ্গে গুনাহের কাজগুলো বর্জনের গুরুত্ব পরিষ্কার হয়। পাপাচার বর্জন করতে না পারলে রোজা রাখা অর্থহীন হয়ে যায়।

কিন্তু যার পক্ষে পাপাচার বর্জন সম্ভব হয় না, কিংবা যে ব্যক্তি রোজা রেখেও অন্যায় কাজ করে তাকে কী পরামর্শ দেওয়া যায়? তার রোজার পরিণতি কী হবে? যেমন গীবত বা পরচর্চা একটি পাপাচার। কোরআন মজিদে এটাকে মরা ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতূল্য বলা হয়েছে। কোনো রোজাদার যদি গীবতের পাপে লিপ্ত হয়, তাহলে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে কি?

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ফকীহ আধ্যাত্মিক সাধক হযরত সুফিয়ান সওরী রহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত ছিল গীবতের কারণে রোজা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি ইমাম গাযযালী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তার অমর গ্রন্থ এহয়াউল উলুমে প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হযরত মুজাহিদ ও হযরত ইবনে সীরীনের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, গীবত রোজা নষ্ট হওয়ার কারণ। এসব মনীষী প্রথমত হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীস দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। দ্বিতীয়ত, তারা যুক্তি দেন যে, পানাহার মৌলিকভাবে হালাল। অথচ রোজার কারণে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়; কিন্তু মিথ্যাচার, গীবত ইত্যাদি কখনই বৈধ নয়। রোজায় এসবের কদর্যতা আরও বেড়ে যায়। রোজা রেখে এগুলোতে লিপ্ত হওয়া আরও গুরুতর অন্যায়। সুতরাং মৌলিকভাবে হালাল ও বৈধ পানাহার যদি রোজা নষ্টের কারণ হয়, তাহলে যেসব কাজ কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়, তাতে লিপ্ত হওয়ার কারণে রোজা নষ্ট হওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত।

অবশ্য সব মনীষী এ যুক্তির গুরুত্ব স্বীকার করেও আইনের ক্ষেত্রে সাবধানী মন্তব্য করার মূলনীতি অনুসারে বলতে চান, অন্যায় কর্ম ও পাপাচারের কারণে সিয়াম সাধনার সুফল কমে যায়, এতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু রোজা নষ্ট হয়ে যাওয়ার রায় দেওয়া সমীচীন হবে না।

মোটকথা তাকওয়া অর্জন ও পাপাচার বর্জনের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের মাস রমজানকে সদ্ব্যবহারেই সিয়াম পালনের সার্থকতা নিহিত।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //