রমজানে মানবিকতার দীক্ষা

আজ মাহে রমজানুল মোবারকের ২০ তারিখ। এ মাসের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে হযরত সালমান ফারসি (রা.) বর্ণিত হাদিসে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, এটা সমবেদনার মাস। যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রয়েছে পাপ মোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং রোজাদারের মতোই তাকে প্রতিদান দেয়া হবে; কিন্তু রোজাদারের প্রতিদান কমানো হবে না। 

রমজানের সিয়াম সাধনার ফলে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতির গুণ আরও জোরদার হয়। সমাজের দুস্থ ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের কষ্ট অনুভব করার সুযোগ এনে দেয় রমজান। মুমিন বান্দারা মানবিকতার দীক্ষা পায় সিয়াম পালনের মাধ্যমে।

এটাকে বলা যেতে পারে রামজানের সিয়াম সাধনার প্রধান সামাজিক তাৎপর্য। আর সমাজবদ্ধতা মানবজাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লামা ইবনে খালদুন তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুকের ভূমিকায় (যা মুকাদ্দামায়ে ইবনে খালদুন নামে পরিচিত) বলেছেন, মানুষের জন্য সমাজ একটি অপরিহার্য বিষয়। এ কথাটি অন্যরা এভাবে বলেন যে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে বা জন্মগতভাবে সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। মানুষ জন্মগ্রহণ করে সমাজে, লালিত পালিত হয় সমাজে, জীবনযাপন করে সমাজে, জীবন সাঙ্গও করে সমাজে। ভূমিষ্ট হওয়ার সময়ে তাকে যেমন দুনিয়াতে স্বাগত জানায়, তেমনি মৃত্যুর সময়ে সমাজই তাকে বিদায় নেয়ার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে।

মানবজাতির পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানুভূতিকে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। কোরআন মজিদে মাতা-পিতা, আত্মীয়স্বজন ও সব মানুষের সঙ্গে সদাচার ও সহানুভূতিমূলক আচরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব অরোপ করা হয়েছে। ইসলামে আত্মীয়দের কর্তব্য পালনের ওপর এতই জোর দেওয়া হয়েছে, বিশ্বের অন্য কোনো ধর্ম ও আদর্শে যার নজীর পাওয়া যায় না। আদম-হাওয়ার সন্তান হিসেবে পৃথিবীর সব মানুষ একই পরিবারের সদস্য এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হতে হবে সহমর্মিতা ও সহানুভূতিমূলক- এটাই ইসলামের শিক্ষা। কোরআন মজিদে মুসলমানদের একে অপরের ভাই বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদিস শরিফে পুরো সৃষ্টি জগতকে আল্লাহর পরিবার সাব্যস্ত করে সৃষ্টির সেবাকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার উপায় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।


হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, গোটা সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। এই পরিবারের কল্যাণে যে ব্যক্তি আত্মনিয়োগ করে, সে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয়।

মহানবী (সা.) গোটা মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, কারো চোখে যন্ত্রণা হলে যেমন পুরো শরীর অস্বস্তি বোধ করে, মাথাব্যথা হলে যেমন পুরো শরীর অসুস্থ হয়, গোটা মুসলিম উম্মাহ এমনই।

পারস্যের কবি শেখ সাদী তার বিখ্যাত গুলিস্তা গ্রন্থে কাব্যিক ভাষায় বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, আদম সন্তানরা একটি দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতো। কেননা তাদের সৃষ্টির মূল উৎস একটাই। একটি অঙ্গে যখন যন্ত্রণা হয়, অন্য অঙ্গগুলোর তখন স্বস্তি থাকে না। অন্যদের ব্যথায় যদি নির্বিকার থাক, তাহলে তুমি মানুষ নামে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য নও।

ইসলাম এমন সমাজব্যবস্থার নির্দেশনা দেয়, যেখানে একে অপরের সুখ ও আনন্দে যেমন শরিক হবে, তেমনি দুঃখ কষ্টের বেলায়ও সবাই একে অপরের পাশে এসে দাঁড়াবে। মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিনদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে সহানুভূতি ও সমবেদনার গুণ অর্জিত হয় বিশেষ করে যারা দুস্থ, অনাহারের কষ্ট যাদের সহ্য করতে হয়, তাদের ব্যথা বোঝার সুযোগ হয় সিয়াম পালনের কারণে। যারা কখনো ক্ষুধার যন্ত্রণা পোহায়নি, খাবারের অভাব কাকে বলে জানে না, তারা কিভাব বুঝবে অভাবী লোকদের ব্যথা? লাগাতার একমাস রোজা রাখার কারণে এই ব্যক্তিরা নিরন্ন মানুষদের প্রতি সদয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারে। পুরো একমাস রোজার হুকুম দেয়ার একটা তাৎপর্য বোঝা যায় এখান থেকে। কেননা দু-একদিন খাবার গ্রহণে ব্যত্যয়ের কোনো প্রভাব নাও পড়তে পারে; কিন্তু লাগাতার একমাস সুনির্দিষ্ট দীর্ঘ সময় খাবার গ্রহণ থেকে বাধ্যতামূলক বিরত থাকার অভিজ্ঞতা অবশ্যই একজন মানুষকে সচেতন করবে। অভাবী ও গরিব মানুষদের প্রতি অন্তরে দয়ার উদ্রেক হবে এবং তাদের কল্যাণে ভূমিকা পালনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে।

রমজানের সিয়াম পালনের মাধ্যমে মুমিন বান্দারা নিজেদের মধ্য থেকে অহমিকা ও গরিমার মতো অশুভ উপাদানগুলো যেমন দূর করতে সক্ষম হয়, তেমনি খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে অক্ষমদের কষ্ট অনুভব করতে পারে। বিশ্বমানবতা একই আদম-হাওয়ার সন্তান বা একই পরিবারের সদস্য হিসেবে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবে, একজনের দুঃখ ও আনন্দে অন্যরাও মানসিকভাবে অংশগ্রহণ করবে, একই দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো পরস্পরের সম্পর্ক হবে নিবিড়-এটাই কাম্য আল্লাহর ও তার প্রেরিত মহাপুরুষদের।

 আসমানি সব শরিয়তের নির্দেশনাই বনি আদমের পারস্পরিক মৈত্রী ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক ও আচরণের। মাহে রমজান উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য সম্প্রীতি ও সমবেদনার অমিয় শিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হয়। রমজানের শেষে ঈদ উৎসবে যেন সচ্ছল পরিবারের সঙ্গে অভাবী পরিবারের সদস্যরাও অংশ নিতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে বিশেষভাবে। ঈদের আগে সদাকাতুল ফিতর আদায়ের বিধান আনন্দ উৎসবে সবাইকে শরিক করে নেওয়ার অনুপম ব্যবস্থা।

এজন্যই মহানবী (সা.) ইসলামের অন্যতম ভিত্তি সাব্যস্ত করেছেন রমজান মাসের সিয়ামকে এবং এ ইবাদতের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন পাস্পরিক সহানুভূতি। তিনি আরও বলেছেন, এ মাসে যে ব্যক্তি তার অধীনস্তের কাজের ভার লাঘব করবে, তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। প্রকৃতপক্ষে অধীনস্তদের প্রতি সদয় আচরণের তাগিদ রয়েছে সারাবছরের জন্য। তাই রমজানের এই শিক্ষা যদি সারাবছর অনুসরণ করা যায়, তাহলে যেমন সিয়াম পালন সার্থক হবে, তেমনি সমাজে নেমে আসতে পারে জান্নাতি পরিবেশ।

লেখক: ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //