দুর্গাপূজা : আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত উৎসব

দুর্গাপূজা বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ সময়কালের অন্যতম ধর্মীয় আয়োজন। সম্প্রতি ইউনেস্কো ভারতের কোলকাতার  দুর্গাপূজাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কোর (UNESCO) Intangible Cultural Heritage of Humanity হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দুর্গাপূজা। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব হওয়ার কারণে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এমনকি পাশ্চাত্য দেশগুলোতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালিরাও দুর্গাপূজার আয়োজন করে থাকেন।

সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গাষষ্ঠী’, ‘মহাসপ্তমী’,‘মহাষ্টমী’,‘মহানবমী’ও ‘বিজয়াদশমী নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন।

দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে পূজা শুরু হয়।

কংস নারায়ণ মন্দিরটি, তাহিরপুর রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব এখান থেকেই শুরু হয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ৮৮৭ বঙ্গাব্দে (১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে) কংস নারায়ণের আহ্বানে মা দুর্গা সাধারণ্যে আবির্ভূত হন। ওই পূজায় পৌরোহিত্য করেছিলেন রাজ পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। মা দুর্গার প্রথম পদধূলিতে ধন্য এই পুণ্যভূমি। কথিত আছে সেই সময় এই পূজায় কংস নারায়ণ ৯ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন।

শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্বকালে পূর্ণ একশ বছর ধরে দেবতা ও অসুরদের ঘোর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে অসুরদের রাজা মহিষাসুর আর দেবতাদের অধীশ্বর ছিলেন ইন্দ্র। ওই যুদ্ধে দেবতারা অসুরদের হাতে পরাজিত হন। দেবতাদের পরাভূত করে মহিষাসুর স্বর্গের অধিপতি হয়ে বসলেন।

পরাজিত দেবতারা একত্রিত হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে অগ্রবর্তী করে ভগবান শিব ও  বিষ্ণুর সমীপে গেলেন। তাঁরা জানালেন, সূর্য, ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, যম, বরুণ ও অন্যান্য দেবতাদের অধিকার হরণ করে মহিষাসুর নিজেই সব অধিকার করে বসেছে। দেবতারা সাধারণ মানুষের মতো পৃথিবীতে বিচরণ করছেন। এই বর্ণনা শুনে মধুসূদন ও মহাদেব অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হলেন। ক্রোধান্বিত চক্রপাণি শ্রী বিষ্ণুর মুখমণ্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হলো। একই সঙ্গে ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকেও বিপুল তেজ নির্গত হলো। মহাতেজের সেই পুঞ্জীভূত রাশি এক জ্বলন্ত পর্বতের মতো দশদিক ব্যাপ্ত করে রাখল। সম্মিলিত তেজের প্রভাবে এক নারী প্রতিমার অবয়ব ষ্পষ্ট হলো। তাঁর দেহের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন দেবতার তেজে গঠিত হলো। এতে মঙ্গলময়ী দেবী দুর্গার আবির্ভাব হলো।

দেবতাদের অস্ত্র ও সরঞ্জামে তিনি সজ্জিতা। সম্মিলিত শক্তির আধেয় দেবী বারংবার অট্টহাস্যে হুংকার করতে লাগলেন। দেবতারা অসীম আনন্দে সিংহবাহিনী ভবানীর জয়ধ্বনি করে বললেন,‘দেবি, তোমার জয় হোক!’ মুনিগণ ভক্তিভরে বিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব করতে লাগলেন। মহিষাসুর এই যুদ্ধে কোটি কোটি সহস্র রথ, হাতি ও অশ্বারোহী সেনাদের নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করল।

সম্মিলিত শক্তি যে ভয়ংকর হতে পারে বড় বড় শক্তিধরদের কাবু করতে পারে দেবী দুর্গা তার জ্বলন্ত প্রতীক। দেবীর সৃষ্টি ও সজ্জা যেমন সম্মিলিত দেবকুলের অংশগ্রহণে হয়েছে দেবী দুর্গার আরাধনায়ও সর্বস্তরের মানুষের অবদান স্বীকৃত হয়েছে। দুর্গাপূজা বনেদি পরিবারকেন্দ্রিক শুরু হলেও এর বিন্যাসগত কারণে বারোয়ারি বা সম্মিলিত পূজানুষ্ঠান জনপ্রিয় হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণও আদৃত হয়েছে।

এই কারণে দুর্গাপূজা ‘জনতার পূজা’হিসেবে মানুষের মনে ঠাঁই নিয়েছে। উন্নয়নের যুগে মানুষ যখন ব্যক্তিক উন্নতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, বড় পরিবারের ধারণা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, সামাজিক সংযোগ ক্ষীণ হচ্ছে তখন বছরের একটি সময়ে সমাজের সব স্তরের মানুষের সম্মিলিত আরাধনার এই ক্ষেত্রটি শক্তিশালী হয়ে সমাজদেহের ক্ষয় নিবারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা নির্বিশেষে সবার পূজা হিসেবে দুর্গাপূজা সামাজিক ঐক্যকে নতুন রূপে সংহত করছে। তাই দুর্গাপুজার সামাজিক একাত্মতার চিত্রটি এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । এই গুরুত্ববহ বিষয়টিকে লালন করা আমাদের কর্তব্য।

সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্যের এই শক্তিকে সারা বছর জিইয়ে রাখার পরিকল্পনা নিলে সম্মিলিত শক্তির কল্যাণরেখা মানুষের কাছে স্পষ্ট হবে। সনাতন ধর্মের  সকল অনুষ্ঠানে দান একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পূজা অনুষ্ঠানকালে দেবীর প্রসাদ হিসেবে অন্নদান করা হয়। বস্ত্রদানও এই পূজা অনুষ্ঠানের একটি অংশ। তবে দরিদ্র, দুর্গত, পীড়িতকে দান সনাতনী আরাধনার অংশ।

দুর্গাপূজার যে বাজেট হয়, তা থেকে সাশ্রয় করে ‘দুর্গত ত্রাণ’-এর জন্য একটি তহবিলের সংস্থান করা হলে এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সহজতর হয় তথা ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও নির্দেশনা অনুসরণ যথাযথ হয়। দেবী দুর্গা যেহেতু দুর্গতকে রক্ষা করেন অতএব, ব্যক্তি মানুষ, গোষ্ঠী বা ধর্মীয়ভাবে শঙ্কাজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যবস্থা গ্রহণ বা মামলা পরিচালনায় এই অর্থ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

দুর্গাপূজা যেহেতু সম্মিলিত শক্তিকে প্রকাশ করে তাই ‘সম্মিলিত সহায়ক ভাণ্ডার’ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এর ফলে দুর্গাপূজার মূল উদ্দেশ্য আরও গভীরভাবে ভক্তদের কাছে ধরা দেবে এবং সামাজিক ঐক্যশক্তির গুরুত্ব সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

দুর্গাপূজার পাঁচ দিনব্যাপী মহাযজ্ঞে এই ঐক্যসুতাকে শক্তিশালী ও স্থায়ীভাবে ফলপ্রদ করার ব্যাপারে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যেমন যত্নবান হবেন ঠিক তেমনি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সহায়তা, সমর্থনও গুরত্বপূর্ণ। এই ঐক্য যেন জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই কল্যাণমুখী দৃষ্টিতে গ্রহণ করে সে ব্যাপারেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে। তবেই তা টেকসই হবে এবং বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

দেবী দুর্গার কাছে তাই কায়মনোবাক্যে ভক্তরা প্রার্থনা করেন-

বিদ্যাবন্তং যশস্বন্তং লক্ষীবন্তং জনং কুরু।

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশ দেহি দ্বিষো জহি ॥

তোমার ভক্তদের তুমি বিদ্বান, যশস্বী ও ধনবান করো তথা রূপ দাও, যশ দাও ও কামক্রোধাদি রিপুদের নাশ করো।

দুর্গাপূজা সামগ্রিক কল্যাণ তথা দেশ ও জাতির উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সামাজিক শৃঙ্খলা ও সৌহার্দের ভিত্তি এই পূজা বৃহত্তর সমৃদ্ধির সূচনা নিশ্চিত করুক এই হোক প্রার্থনা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //