হজের খরচ বাড়ছে

করোনা ভাইরাস মহামারি কাটিয়ে এবার স্বাভাবিকভাবে হজ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে সৌদি আরব সরকার। তাই করোনার আগের কোটা ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে হজ পালনে ইতিমধ্যে সৌদি সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী, গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ মানুষ এবার হজ পালন করতে পারবেন। তবে এবার হজ পালনে গত বছরের চেয়েও বেশি খরচ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কোটা বাড়লেও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে ইচ্ছুক বিপুল সংখ‌্যক প্রাক-নিবন্ধিত হজযাত্রীকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। 

অন‌্যদিকে হজ সামনে রেখে এক শ্রেণির প্রতারকের তৎপরতাও শুরু হয়েছে। তাই এ বিষয়ে হজে গমনেচ্ছুদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৮ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি বছর হজ পালনে গত ৯ জানুয়ারি সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক হজচুক্তি করেছে বাংলাদেশ।

শিগগিরই হজ প্যাকেজ ঘোষণা

চলতি জানুয়ারি মাসেই হজ প‌্যাকেজ ঘোষণা হতে পারে বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে। গত ১৫ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান জানিয়েছিলেন, ২৫ থেকে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে চলতি বছরের হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে। 

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিমান ভাড়া নির্ধারণ হওয়ার পর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে। এরপর হজ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভায় হজ প‌্যাকেজ চূড়ান্ত করে ঘোষণা করা হবে। মন্ত্রী ঘোষণা দিলেও জানুয়ারি মাসের মধে‌্য এটা সম্ভব কিনা সেই বিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ হজ প‌্যাকেজ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেক খরচ এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি।

বহাল আগের কোটা, উঠল বয়সের নিষেধাজ্ঞা

গত ৭ জানুয়ারি সৌদি আরব যান ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। ৯ জানুয়ারি সম্পাদিত হজচুক্তি অনুযায়ী করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে এ বছর বাংলাদেশের কোটার পূর্ণ সংখ্যক অর্থাৎ সর্বমোট এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী হজে যেতে করতে পারবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জন হজযাত্রী হজে যাবেন। হজ টিমের (প্রশাসনিক ও মেডিক্যাল) সদস‌্য হিসেবে সৌদি আরবে যেতে পারবেন এক হাজার ২৭০ জন। এ বছর বয়সের সর্বোচ্চ সীমার শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা এ বছর হজে যেতে পারবেন।

এদিকে করোনার কারণে সৌদি আরবের নিষেধাজ্ঞায় ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে কেউ হজ পালন করতে পারেনি। ২০২১ সালেও বিদেশিদের জন্য হজ পালনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। করোনা কমে এলে গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে কোটা অর্ধেক করে হজ পালনের অনুমতি দেয় সৌদি আরব। বাংলাদেশ থেকে ৬০ হাজার মুসলমান হজ পালন করেন। 

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৫০ শতাংশ ও সৌদি এয়ারলাইন্স ৫০ শতাংশ হজযাত্রী পরিবহন করবে। চুক্তি অনুযায়ী, রুট টু মক্কা ইনিশিয়েটভ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে হজে গমনকারী হজযাত্রীর ইমিগ্রেশন ঢাকায় সম্পন্ন হবে। কোভিড পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে হজযাত্রীর সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। এ বছর বাংলাদেশি হজযাত্রীর ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৮৯ হাজার ৩৮ জন জেদ্দা বিমানবন্দর হয়ে এবং ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৮ হাজার ১৬০ জন মদিনা বিমানবন্দর হয়ে যাওয়া-আসা করবেন বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

খরচ বাড়বে

চলতি বছর হজের খরচ বাড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খরচ গত বছরের মতো রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সৌদি রিয়ালের দাম বাড়ার কারণে সেটা সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে হজের সবচেয়ে বড় খরচ বিমান ভাড়াও এবার গত বছরের চেয়ে বাড়বে। তাই স্বাভাবিকভাবেই হজ পালনে খরচ বাড়বে। গত বছর সরকারিভাবে হজে যেতে প্যাকেজ-১-এ ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ এবং প্যাকেজ-২-এ ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা খরচ হয়েছে। বেসরকারিভাবে এজেন্সিগুলোর সাধারণ প্যাকেজের মাধ্যমে হজ পালনে খরচ ধরা হয়েছিল ৫ লাখ ২২ হাজার ৭৪৪ টাকা।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, হজ প্যাকেজের মূল্য গত বছরের মতো রাখার চেষ্টা করা হবে। তবে রিয়ালের মূল্য বাড়ায় খরচ কিছুটা বাড়তে পারে। যেটা আছে সেটাকে রাখার জন্য আমরা চিন্তা করছি। তারপরও কিন্তু বাড়বে। রিয়ালের দাম ছিল ২১-২২ টাকা, এখন হয়েছে ৩০ টাকা। তাহলে ৩৩ শতাংশ তো এমনিই বেড়ে গেল। আমরা কিছু বাড়ালাম না, কিন্তু ৩৩ শতাংশ যে বাড়ল সেটা কীভাবে কমাবেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্লেন ভাড়া নির্ধারণে ইতিমধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়। গত বছরের ভাড়া ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। জ্বালানির দাম বেড়েছে বলে এবার বিমান গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া ধার্য করেছে। তবে ধর্ম মন্ত্রণালয় সেটা মেনে নেয়নি। বিমানকে তাদের প্রস্তাব ফের পর্যালোচনা করে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে সৌদি প্রান্তের বিভিন্ন খরচ বাড়তে পারে। তবে খরচ কমাতে ধর্ম মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে দেন-দরবার করছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

প্রাক-নিবন্ধিত অনেকেই হজে যেতে পারবেন না

হজ পালনে বাংলাদেশ আগের কোটা ফিরে পেলেও বেসরকারি ব‌্যবস্থাপনায় হজে যেতে ইচ্ছুক প্রাক-নিবন্ধিত অনেকেই এবার হজে যেতে পারবে না। প্রতিদিনই প্রাক-নিবন্ধিত হজযাত্রীর সংখ‌্যা বেড়েই যাচ্ছে। গত ২৩ জানুয়ারি সর্বশেষ তথ‌্য অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব‌্যবস্থাপনার ১৫ হাজারের বিপরীতে ১৫ হাজার ৭০ জন প্রাক-নিবন্ধন করেছেন। 

অন‌্যদিকে বেসরকারি ব‌্যবস্থাপনায় এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জনের বিপরীতে প্রাক-নিবন্ধন করেছেন ২ লাখ ৫০ হাজার ৫৫২ জন। বেসরকারি ব‌্যবস্থাপনার প্রাক-নিবন্ধিত অনেককেই পরের বছর হজ পালনের জন‌্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের সতর্কবার্তা

হজে যাওয়া নিয়ে প্রতিবছর অনেকে প্রতারণার শিকার হন। জীবনের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত এই ইচ্ছা পূরণে বহু কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে বিপদে পড়েন। আর হজে যাওয়া হয় না। এ জন‌্য এ বিষয়ে আগেই সতর্কতা জারি করেছে সরকার। প্রতারণা রোধে এবার হজে যেতে এজেন্সির দায়িত্ববান প্রতিনিধি নয় এমন ব্যক্তি বা গ্রুপ লিডারের মাধ্যমে লেনদেন না করে সরাসরি এজেন্সি ও ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করার পরামর্শ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করে মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, “বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে গমনেচ্ছু ব্যক্তি ও এজেন্সিসমূহের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, ‘হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২২’ অনুসারে হজের নিবন্ধনের পূর্বেই হজযাত্রীর সঙ্গে হজ এজেন্সির লিখিত চুক্তি সম্পাদন, এজেন্সির দায়িত্ববান প্রতিনিধি নয় এমন ব্যক্তি/গ্রুপ লিডারের মাধ্যমে লেনদেন না করে সরাসরি এজেন্সির সঙ্গে এবং ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা বাঞ্ছনীয়।”

একই সঙ্গে হজযাত্রীর কাছ থেকে অর্থ গ্রহণের বিপরীতে অর্থ গ্রহণের প্রমাণ দেওয়া প্রয়োজন। হজ সংক্রান্ত সব ক্ষেত্রে ‘হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২১’ এবং ‘হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২২’-এর অনুসরণসহ সকল প্রকার আর্থিক লেনদেন যথাযথ প্রতিনিধি, অংশীদার, স্বত্বাধিকারীর মাধ্যমে এবং রসিদ/ব্যাংক রসিদের মাধ্যমে করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ জানিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

গত বছর কোটার অর্ধেক হজ পালন করলেও বিপুল সংখ‌্যক হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অর্ধ শতাধিক এজেন্সিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। অনেক এজেন্সিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, কোনো কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়।

নিজস্ব উড়োজাহাজ ব‌্যবহার করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ বছর হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য উড়োজাহাজ ইজারা না নিয়ে নিজস্ব উড়োজাহাজ ব্যবহার করবে। ইতোমধ্যে জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম বলেছেন, যেহেতু আমরা লিজ প্রক্রিয়া থেকে উপকৃত হই না, তাই আমরা হজ ফ্লাইটের জন্য আমাদের নিজস্ব উড়োজাহাজ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হজ ফ্লাইট নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

চলতি বছরের হজ চুক্তি অনুযায়ী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং সৌদিয়া এয়ারলাইন্স এ বছর ৫০ শতাংশ হজযাত্রী বহন করবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //