আগামী বছর কেমন হবে হজের খরচ

চলতি বছর খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় হজে যেতে মানুষের আগ্রহ কম ছিল। দফায় দফায় নিবন্ধনের সময় বাড়িয়েও হজযাত্রীর কোটা পূরণ করা যায়নি। আগামী বছর বাংলাদেশ থেকে হজ পালনের রূপরেখা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সৌদি আরবের হজমন্ত্রীও বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। এবারও হজের কোটা গত বছরের মতো একই রয়েছে বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। সৌদি হজমন্ত্রীর কাছে খরচ কমানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিনি বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হজের বড় খরচটি চলে যায় বিমান ভাড়ায়। আরেকটি বড় খরচ সৌদি অংশে ওই দেশের সরকার নির্ধারিত। বিমান ভাড়া যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয় না বলে হজ এজেন্সি মালিকরা গত কয়েক বছর ধরে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন। তবে এবার হজ এজেন্সিগুলোর প্রতিবাদ জোরালো ছিল। তারা এ বিষয়ে এবার প্রধানমন্ত্রীরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তবে ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং হজ এজেন্সি মালিকরা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বছরের হজের খরচে খুব বেশি পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা দেখছেন না। সেক্ষেত্রে এবারও প্রাক-নিবন্ধন করা অনেকের হজ করার বাসনা অপূর্ণ থাকতে পারে।

নিবন্ধন শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর, আগের কোটাই বহাল

চলতি বছরের মতো আগামী বছরও (২০২৪ সাল) বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারবেন। সৌদি সরকার এ কোটা অনুমোদন করেছে বলে ২ আগস্ট সচিবালয়ে ১৪৪৫ হিজরি/২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের হজ অনুষ্ঠান বিষয়ের প্রাক-প্রস্তুতি সভায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার জানান। তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালের হজযাত্রী নিবন্ধন আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। আগামী বছরের ১ মার্চ থেকে হজ ভিসা ইস্যুকরণ, সৌদি ই-হজ সিস্টেমে ২৯ এপ্রিল ভিসা ইস্যু বন্ধ হবে এবং ৯ মে থেকে হজ ফ্লাইট শুরু হবে।

সৌদি সরকারের কাছ থেকে মিনা-আরাফা-মুজদালিফার সেবা মূল্য জানামাত্র হজ প্যাকেজ ২০২৪ ঘোষণা করা হবে এবং হজযাত্রীদের নিবন্ধন কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা হবে বলেও জানান সচিব।

চলতি বছরের খরচ ছিল বেশিরভাগের সাধ্যের বাইরে

চলতি বছরের ২৭ জুন (৯ জিলহজ) পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের সঙ্গে হজচুক্তি অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ করতে পারতেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৫ হাজার ও অবশিষ্ট এক লাখ ১২ হাজার ১৯৮ জনের বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করার সুযোগ ছিল।

এবার সরকারিভাবে হজ পালনে খরচ নির্ধারণ করা হয় ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে এজেন্সির মাধ্যমে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয় ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে কোরবানির খরচ।

গত বছর সরকারিভাবে দুটি প্যাকেজের মাধ্যমে হজ হয়। সেই অনুযায়ী প্যাকেজ-১-এর ক্ষেত্রে এবার খরচ বাড়ে ৯৬ হাজার ৬৭৮ টাকা, প্যাকেজ-২-এর ক্ষেত্রে খরচ বাড়ে এক লাখ ৬১ হাজার ৮৬৮ টাকা। বেসরকারিভাবে হজ পালনে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বাড়ে এক লাখ ৪৯ হাজার ৮৭৪ টাকা।

হজের খরচ বাড়ার বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়, হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) জানিয়েছিল, বিমানভাড়া, মক্কা-মদিনার বাড়িভাড়া ও পরিষেবা খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে ডলার ও সৌদি মুদ্রা রিয়েলের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে হজ পালনের খরচ বেড়েছে। গত বছর যাওয়া-আসার (রাউন্ড ট্রিপ) বিমানভাড়া ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। চলতি বছর ৫৭ হাজার ৭৯৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা।

পরে সৌদি প্রান্তের খরচ কমায় গত ২২ মার্চ সরকারি ও বেসরকারি হজের প্যাকেজ মূল্য কমানোর ঘোষণা দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। তখন মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, সরকারি ব্যবস্থাপনায় মিনার তাঁবু ‘সি’ ক্যাটাগরি ধরে প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়েছে, তাই সরকারি প্যাকেজ মূল্য ৪১৩ সৌদি রিয়াল সমপরিমাণ ১১ হাজার ৭২৫ টাকা কমানো হয়েছে। এজন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় বর্তমান হজ প্যাকেজ মূল্য কমিয়ে ৬ লাখ ৭১ হাজার ২৯০ টাকা নির্ধারণ করা হলো।

হজ এজেন্সিজগুলোও মিনার তাঁবু ‘সি’ ক্যাটাগরি ধরে প্যাকেজ নির্ধারণ করেছে, তাই বেসরকারিভাবে হজ পালনে প্যাকেজ মূল্য কমিয়ে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৮৯০ টাকা নির্ধারিত হয়েছিল।

কিন্তু এ অর্থ বেশিরভাগের সাধ্যের বাইরে। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি হজের নিবন্ধন শুরু হয়। এরপর আট দফা বাড়ানো হয় নিবন্ধনের সময়। শেষে নবম দফায় ২৫ এপ্রিল নিবন্ধনের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। এর পরও কোটা পূরণ হয়নি। এবার বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২২ হাজার ৮৮৪ জন হজ পালন করে। ৪ হাজার ৩১৪ জনের কোটা খালি থেকে গেছে। যদিও তখনো বিপুল সংখ্যক প্রাক-নিবন্ধিত হজযাত্রী অপেক্ষমাণ ছিলেন। খরচ বেশি থাকায় তারা কেউ নিবন্ধন করেননি।

খরচ কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করবে সৌদি

২৩ আগস্ট সচিবালয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রাজকীয় সৌদি আরব সরকারের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী তৌফিক বিন ফাউজান আল রাবিয়াহের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক সভা করেন ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান।

হজের খরচ কমানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা—এ প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তারা বলেছেন যদি খরচ কমানো সম্ভব হয়, আমরা কমাব।

তৌফিক আল-রাবিয়াহ বলেন, বাংলাদেশিদের সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনায় স্বাগত জানাতে আমরা এখানে এসেছি। ওমরাহ ভিসার মেয়াদ ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ দিন করা হয়েছে। যে কেউ মক্কা, মদিনাসহ বিভিন্ন শহর ঘুরতে পারবেন। সৌদির উন্নয়নে সহায়তা করছেন বাংলাদেশিরা। ২৮ লাখ বাংলাদেশি বর্তমানে সৌদি আরবে কাজ করছেন।

এরপর ওই দিন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিমান চলাচল সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, সৌদি আরব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বাংলাদেশের মনোনীত বিমান সংস্থা বাংলাদেশের যে কোনো পয়েন্ট হতে সৌদি আরবের যে কোনো আন্তর্জাতিক পয়েন্টে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে।

খরচ আরও বাড়বে জানিয়েছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়

বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও সৌদি আরবের হারাম শরীফের কাছাকাছি বিভিন্ন হোটেল ভেঙে ফেলায় আগামী বছরগুলোতে হজের খরচ আরও বাড়বে, তাই এবারের হজ প্যাকেজকে সর্বনিম্ন হিসেবে বিবেচনা করছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ তথ্য জানিয়ে হজে গমেনেচ্ছুদের এবার হজে যেতে নিবন্ধন করার অনুরোধ জানিয়েছিল মন্ত্রণালয়টি।

চলতি বছরের ২ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় জানায়, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও সৌদি আরবের হারাম শরীফের নিকটবর্তী বিভিন্ন হোটেল ভেঙে ফেলায় এ বছর হোটেলের ভাড়া নেওয়ার সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং অধিক পরিমাণ অর্থে হোটেল ভাড়া করা হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় বিভিন্ন কারণে এ বছরের হজ প্যাকেজকে হ্রাসকৃত প্যাকেজ হিসেবে ধরা যায় এবং সেই বিবেচনায় একই ধারাবাহিকতায় বলা যায় যে, আগামী বছরগুলোতে হজ প্যাকেজের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ ভেঙে ফেলা বাড়ি/হোটেল আবার গড়ে তুলতে আরও ২/৩ বছর লাগবে। এমতাবস্থায়, এ বছরের ঘোষিত হজ প্যাকেজই সর্বনিম্ন হিসেবে বিবেচনা করা যায় বলে জানিয়েছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়।

খরচের বিষয়ে কী ভাবছে মন্ত্রণালয় ও হাব 

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার হজের খরচ আর বাড়বে না এটা মোটামুটি বলা যায়। তবে কমবে কিনা—এটা এখনই বলা যাচ্ছে না। মূল যে কারণে হজের খরচ বেশি হয় সেগুলো ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হাতে না। মূল খরচ দুটি হলো বিমান ভাড়া ও সৌদি সরকার নির্ধারিত বিভিন্ন সেবার ফি। বিমান ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হাতে। বিমান ভাড়া নির্ধারণের মিটিংয়ে হজযাত্রীদের স্বার্থ আমরা (ধর্ম মন্ত্রণালয়) সবসময় দেখি। আর সৌদি প্রান্তের ফির ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা করে যতটুকু কমানো যায় সেই পদক্ষেপ আমরা নেব।

হাব নেতারা বলেছেন, আমরা বলে আসছি, হজের বিমান ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি সঠিক নয়। এর মাধ্যমে হজযাত্রীদের স্বার্থ রক্ষা হয় না। যারা সেবা দেবেন তারাই যদি নিজেদের ফি নির্ধারণ করে নেন, এটা তো হয় না। তৃতীয় কোনো পক্ষ বা কারিগরি লোকজনের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। এবার আমাদের এ অবস্থানে আরও অটল থাকব। আশা করি, সরকার হজযাত্রী বান্ধব দাবিটি আমলে নেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //