রবিউল আউয়ালের বার্তা

হিজরি বর্ষপঞ্জির তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। আরবি রবিউল আউয়াল শব্দের অর্থ প্রথম বসন্ত কিংবা বলা যেতে পারে বসন্তের সূচনা। এমন এক বসন্ত এসেছিল দেড় হাজার বছর আগে।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে মানবতার জগৎ যখন গ্রীষ্মের খরতাপ ও শীতের জড়তায় কাবু হয়ে পড়েছিল, মানুষের মনুষ্যত্ব যখন আশরাফুল মাখলুকাতের সুউচ্চ অবস্থান থেকে অধঃগতির টানে নেমে গিয়েছিল নিকৃষ্টতার নিম্নতম স্তরে, তখন ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে মরু আরবের এক জীর্ণ কুটিরে মা আমিনার কোল উজালা করে পৃথিবীর মাটিতে শুভাগমন ঘটল এক শিশুর। মায়ের উদরে থাকার সময়েই পিতৃহারা হওয়া যে শিশুটিকে দাদা আবদুল মুত্তালিব ‘মুহাম্মদ’ বলে এক অসাধারণ নাম দিলেন, যার আগমনে পৃথিবীতে মানবজগতে বসন্তের পুনরাগমনের বার্তা ঘোষিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন মহাবিশ্বের এক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টা ও নিয়ন্তা। এই মহামনীষীর জন্মের সময়টা ছিল রবিউল আউয়াল মাস। প্রকৃতির জগৎ তাকে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসেবে চিনতে পেরেছিল প্রথম দিন থেকেই। এজন্য শৈশব ও কৈশোরে তার অনুপম চরিত্র মাধুর্য ও অনন্য গুণাবলির অধিকারী হিসেবে সাধারণ মানুষেরা মুগ্ধ হওয়ার আগেই জড় পদার্থ ও উদ্ভিদের পক্ষ থেকে তিনি পেয়েছেন সম্ভাষণ।

মক্কা ও আরব সমাজে অবিসংবাদিত এই ব্যক্তিটিকে ৪০ বছর বয়সের সময় ঘোষণা করা হলো স্রষ্টার প্রেরিত ও বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে। দায়িত্ব অর্পণ করা হলো নিজ গোত্র ও সমাজের মানুষদের কাছে জগতপ্রভুর একত্বের বাণী প্রচারের। বিপত্তি ঘটল এখানেই। যার সততা ও সাধুতার স্বীকৃতি দিতে কারও সামান্যতম কুণ্ঠা ছিল না, জগৎপ্রভুর তাওহীদে বিশ্বাসের আহ্বান জানানোর কারণে তার শত্রু হয়ে দাঁড়াল সেই মানুষেরা, যারা পৃথিবীবাসীর ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ঘরের প্রতিবেশী হিসেবে পরিচিত হতে গর্ববোধ করত। নবীর দাওয়াতে যারা সাড়া দিয়েছেন, সেই মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গেল দুঃসহনীয়ভাবে। স্বয়ং মহানবীর (সা.) ওপর আঘাত হানতেও এতটুকু দ্বিধা করল না এই অবিশ্বাসীরা। তাই এক পর্যায়ে ইয়াছরিব পল্লীর বাসিন্দাদের প্রস্তাবে তিনি স্বয়ং সেখানে হিজরত করলেন। ইয়াছরিব পল্লীর নাম বদলে হয়ে গেল মদীনাতুন নবী বা সংক্ষেপে মদীনা। অচিরেই মহানবী (সা.) মুসলমানদের নিয়ে স্থানীয় ইহুদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সনদ প্রণয়ন করলেন এবং বিশ্ববাসীকে উপহার দিলেন ইতিহাসের প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। মদীনার সনদ নামে আখ্যায়িত এই দলিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনন্য সংযোজন।

কিন্তু আল্লাহর নবী ও তাঁর অনুসারীরা মদীনায় নির্বিঘ্নে বসবাস করার সুযোগ পেলেন না। মক্কার কুরাইশরা বরং নবী ও তাঁর অনুসারীদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের পথে অগ্রসর হলো। তাই সামরিক উপায়ে তাদের মোকাবিলা করার অনুমতি দেওয়া হলো সত্যধর্মের প্রচারক ও তার সহচরদের। ইরশাদ হলো, “যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তাদের অনুমতি দেওয়া হলো। কেননা তারা অত্যাচারিত হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে নিশ্চয়ই সক্ষম। যাদেরকে নিজেদের বাড়ি থেকে শুধু এজন্য অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে যে, তারা বলে আমাদের প্রভু আল্লাহ।”(সূরা হজের ৩৯ ও ৪০নং আয়াত)। 

মহান প্রভুর পক্ষ থেকে অনুমতি লাভের পর কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রথম সশস্ত্র সামরিক মোকাবিলা হয় বদর প্রান্তরে। একদিকে সুসজ্জিত ও উপকরণ সমৃদ্ধ সহস্র সৈন্যের বাহিনী। অন্যদিকে এই বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম মাত্র ৩১৩ জন প্রায় নিরস্ত্র ও সরঞ্জামহীন মুজাহিদকে নিয়ে নেমেছেন আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাদের প্রধান সম্বল ও পুঁজি ছিল মহান রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান ও তাওয়াক্কুল। অবিশ্বাসীদের দর্প ও দম্ভ চুরমার হয়ে গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। কাফেরদের প্রায় সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিই নিহত হলো। সাথীসহ তাদের নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৭০। বন্দি হলো আরও ৭০ জন। অন্যদিকে মহানবীর (সা.) সাথীদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন বদরের পর উহুদ, খন্দক, খায়বর ইত্যাদি যুদ্ধেও আল্লাহর নবীর প্রচারিত দীনের সত্যতা প্রমাণ হলো। এত দিন বিরোধিতা করে আসা মক্কার কুরাইশরা বাধ্য হলো আল্লাহর নবী ও মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদনে। হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত এই চুক্তির সুবাদে মহানবী (সা.) অবকাশ পেলেন সমকালীন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর উদ্দেশে দাওয়াতী পত্র প্রেরণের। পারস্য-রোমান-মিশর-হাবশার সম্রাটদের আহ্বান জানানো হলো। এভাবে শেষ নবী নিজের বিশ্বজনীনতার প্রমাণ দিলেন।

মক্কার কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি লঙ্ঘন করল। মহানবী (সা.) প্রতিকার দাবি করলেন। কুরাইশরা তাতে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলো। ফলে মক্কায় অভিযান চালানো অনিবার্য হয়ে পড়ল। প্রায় বিনা রক্তপাতে মক্কার পবিত্র ভূমিতে ইসলামের পতাকা স্থাপিত হলো। বিজিতদের সঙ্গে বিজয়ীদের আচরণের অনুপম আদর্শ স্থাপন করলেন আল্লাহর নবী। কুরাইশদের ওপরে মহানবীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল আরবের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের ইসলাম গ্রহণের সব প্রতিবন্ধকতা দূর হলো। গোটা আরব উপদ্বীপে এক অদ্বিতীয় মহান প্রভুর ছাড়া অন্য কারও ইবাদতের মানুষ রইল না। লক্ষাধিক মুসলমানকে নিয়ে তিনি যখন জিলহজ মাসের নয় তারিখে আরাফা ময়দানে অবস্থান করছিলেন, তখন নাযিল হলো কোরআন মাজীদের সূরা মায়েদার তিন নং আয়াত। তাতে ঘোষণা করা হলো মানবজাতির প্রতি নির্দেশিকা প্রেরণের খোদায়ী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্ব সম্পন্ন হওয়ার, বনি আদমের জন্য প্রেরিত বিধানের পূর্ণাঙ্গতা দানের এবং দীন হিসেবে ইসলামের অদ্বিতীয়তার বার্তা। 

হজ পালনের পর মদীনায় ফিরে অল্পকালের মধ্যে আল্লাহর শেষ নবী (সা.) অসুস্থ হলেন। রাব্বুল আলামীনের অমোঘ বিধান অনুযায়ী তার পৃথিবীর জীবনকাল সমাপ্ত হলো। আপন প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন অন্তরালে। এটাও ঘটল রবিউল আউয়াল মাসে। তাই রবিউল আওয়াল একই সঙ্গে দুনিয়াতে মহানবীর শুভ আগমন ও দুনিয়া থেকে তিরোধানের মাস। তাই শেষ নবীর রেখে যাওয়া শরীয়ত পরিপালনে যত্নবান হওয়ার এবং নবীর সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনের সব ক্ষেত্র ও স্তরকে সাজানোর প্রতিজ্ঞার আহ্বান নিয়ে প্রতিবছর আগমন করে মাহে রবিউল আউয়াল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //