সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের প্রসঙ্গ এলেই ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক মেলবন্ধন দেখতে পাওয়া যায়। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আটটি পরগনার নিষ্কর জায়গির পেলেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। এই নিষ্কর জায়গির ছিল চব্বিশ পরগনার আটটি পরগনাব্যাপী, যার বিস্তৃতি হালিশহর থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত।

যে লক্ষ্মীকান্তপুরের নাম আমরা জানি, তা লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের নামানুসারেই হয়েছিল। জায়গিরদারির সঙ্গে তিনি পেয়েছিলেন রায়, মজুমদার এবং চৌধুরী উপাধি, যে উপাধিগুলোর কারণে এই পরিবার সাবর্ণ (গোত্র) রায় চৌধুরী নামে পরিচিতি পায়। এই পরিবারের বাইশতম পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত পরিচিত ছিলেন রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরী নামে। পরবর্তীকালে পরিবারের উত্তরসূরিরা মজুমদার পদবিটির ব্যবহার করা বন্ধ করে কেবল রায় ও চৌধুরী পদবিরই ব্যবহার বজায় রাখলেন। 

জায়গিরদারি পাওয়ার পর লক্ষ্মীকান্ত তার আদি বাসস্থান অর্থাৎ হালিশহর থেকে বড়িশা পর্যন্ত পাকা রাস্তা নির্মাণ করলেন, যা হলো কলকাতার প্রথম পাকা সড়ক। এই সড়কের নাম ছিল পুরাতন রাস্তা (ব্রিটিশ রাজত্বকালে, Pilgrims’Road), অধুনা ডায়মন্ড হারবার রোড এবং আংশিক চিৎপুর এলাকা। সহস্রাধিক ইউরোপীয়ের বসবাস ছিল সেই সময় কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়, যাদের মধ্যে পর্তুগিজ, আর্মেনীয়, ডাচ থাকলেও ব্রিটিশরা ছিল না।

নিমতা বাড়ি-মায়ের চক্ষুদান

প্রথমে হালিশহর এবং তারপর ১৬৫০ থেকে ১৭১৬ পর্যন্ত নিমতা বিরাটি ছিল সাবর্ণ পরিবারের জায়গিরের রাজধানী। ১৭১৬ সালে বড়িশা হয়ে উঠল সাবর্ণ জায়গিরের রাজধানী। ভারতবর্ষে সাবর্ণ পরিবারের জায়গিরদারি পরিচালনা করার পাঁচটি মূল কেন্দ্র ছিল সমগ্র হালিশহর, নিমতা-বিরাটি-বেলঘরিয়া-পানিহাটি, বড়িশা, পশ্চিম মেদিনীপুরের খেপুত এবং উত্তরপাড়া জুড়ে।

১৬১০ সালে রায় চৌধুরী পরিবারের সর্ববৃহৎ জনপদ বড়িশায় লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী ও তার স্ত্রী ভগবতী দেবী শুরু করেন দুর্গাপূজা। এই পূজা কলকাতায় প্রথম সপরিবারে দেবীর আরাধনা, অর্থাৎ কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা থাকলেন একই কাঠামোর মধ্যে। এই বছর ৪১৪ বছরে পদার্পণ করল এই দুর্গাপূজা। রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজায় গ্রামের প্রতিটি প্রজা ভালোবেসে ও আনন্দে যোগদান করত।

যে সময় এই দুর্গাপূজার সূচনা, সেই সময় কলিকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতালুটা (বর্তমানে সুতানুটি) এই তিনটি গ্রামের প্রজাস্বত্ব হস্তান্তর হয়নি। বর্তমান দুর্গাপূজার যাবতীয় বিবর্তন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের হাত ধরে। এর আগে কংসনারায়ণ যে দুর্গা পূজা করতেন, তা ছিল চণ্ডী রূপে মায়ের একক আরাধনা। লক্ষ্মীকান্ত শুরু করলেন সপরিবার দুর্গার পূজা, অর্থাৎ একই চালচিত্রে মা থাকবেন তার পরিবারসহ, যা আজ আমরা দেখতে পাই। এই প্রথম কার্তিকের শূদ্র যোদ্ধা রূপ পরিবর্তিত হয়ে তিনি হলেন এক ব্রাহ্মণ রাজকুমার। এই পূজা শুরু হওয়ার আগে কৃষ্ণবর্ণের কার্তিক পূজিত হতেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই পূজার সূত্র ধরেই উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও শুরু করলেন কার্তিকের পূজা। 

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে মোট আটটি দুর্গাপূজা হয়-বড়িশাতে ছয়টি, নিমতা পাঠানপুর বাড়িতে একটি ও বিরাটি বাড়িতে একটি। বড়িশায় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মেজো বাড়ি, মাঝের বাড়ি, কালিকিংকর ভবন, বেনাকি বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজা। কথা প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, বড়িশাতে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের মহেশ ভবনে (চণ্ডী বাড়ি) দুর্গাপূজার পরিবর্তে হয় মা চণ্ডীর আরাধনা। 

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের মূল দুর্গাপূজা হলো সাঁঝার আটচালা বাড়ির পূজা, যা লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী প্রচলন করেছিলেন ১৬১০ সালে। প্রতিবছর, কৃষ্ণা নবমী তিথিতে বড়িশা আটচালা বাড়িতে মহামায়ার বোধনের মধ্যে দিয়ে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে সূচনা হয় সেই বছরের মাতৃ আরাধনার। প্রথা অনুযায়ী সাবর্ণ পরিবারের বাকি সাতটি বাড়িতে (বড় বাড়ি, মেজো বাড়ি, বেনাকী বাড়ি, কালিকিংকর ভবন, মাঝের বাড়ি, বিরাটি বাড়ি ও নিমতা পাঠানপুর বাড়ি) বোধন হয় ষষ্ঠী তিথিতে।

বড়িশা গ্রামে কাছারি বাড়ি সংলগ্ন জমিতে আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করে মাতৃ আরাধনার প্রবর্তন করেন লক্ষ্মীকান্ত। লক্ষ্মীকান্ত অত্যন্ত প্রজা-দরদি ও বিচক্ষণ জমিদার ছিলেন। বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করে রাজকীয় আভিজাত্যে পরিপূর্ণ দেবীপূজা করার ইচ্ছে থাকলেও তিনি তা করলেন না, যাতে তার প্রজারা নির্ভয়ে একান্ত আপনার ভেবে মাতৃপূজায় অংশগ্রহণ করতে পারে। নিজের কাছারি বাড়ি সংলগ্ন জমিতে তিনি কাঠের থামে তালপাতা আর হোগলাপাতার ছাউনি দেওয়া চণ্ডীমণ্ডপ নির্মাণ করালেন। এই আদি চণ্ডীম-পকে ‘সাঁঝার আটচালা’ (সাঁঝার অর্থ সবার) বলা হয়। 

কালের অগ্রগতিতে আটচালা ক্রমে বিবর্তিত হলো বাঁশের কাঠামোর ওপরে টালির ছাউনিতে, যা ক্রম বিবর্তনে হয়ে উঠেছে কংক্রিটের। এই আটচালার সামনে প্রাচীন বনেদিয়ানার অহংকারে মাথা তুলে জেগে রয়েছে লক্ষ্মীকান্তর সেই কাছারি বাড়ির লাল রঙা ১০টি থাম। এই আটচালা কংক্রিটের এবং পূজার বেদিটি পাকা করা হলেও তার মাঝখানে সংরক্ষিত আছে সেই ঐতিহাসিক ৪১৪ বছরের প্রাচীন আদি মাটির বেদিটি। প্রতিবছর বিসর্জনের পর প্রতিমার প্রাচীন কাঠামোটিকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তার প্রয়োজনীয় মেরামতি ও সংরক্ষণ সেরে আবার তাতেই প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। রায় চৌধুরী পরিবারের এই পূজা একসময় স্মৃতিতীর্থ বা কাব্যতীর্থ পুরোহিত ছাড়া কেউ করতে পারতেন না। ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ও সংস্কৃতে বিশেষ জ্ঞানবান পুরোহিত ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা প্রায় বংশপরম্পরায় এই পূজার সঙ্গে যুক্ত। এমনকি ঢাকিরাও বংশপরম্পরায় সানন্দে এই পূজায় যোগদান করতে আসেন। জায়গিরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অসংখ্য প্রজার জন্য পূজার পাঁচটি দিন জমিদার বাড়ির থাকত অবারিত দ্বার। এভাবেই কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপূজা শুরু হলো বড়িশার আটচালাতে। 

মৈথিল কোকিল, কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’তে বর্ণিত তান্ত্রিক মতানুসারে পূজার নিয়মাবলি মেনে এই দুর্গাপূজা সম্পন্ন করা হয়। কথিত আছে, শ্রীরামচন্দ্র এই পুঁথিতে বর্ণিত নিয়মানুসারে পূজা করেছিলেন। তন্ত্র মতে পূজা শুরু হলেও, ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে পৌঁছে সেখানে তিনটি মত-শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব এসে কোথাও মিশে যায়। এই পরিবারে মাতৃ আরাধনা করা হয় ত্রিধারা সঙ্গমে। ত্রিধারা সঙ্গম অর্থাৎ যেখানে হিন্দুধর্মের মূল তিন ধারা শাক্ত, বৈষ্ণব এবং শৈব মত অনুসরণ করে দুর্গাবন্দনা করা হয়। এই ত্রিধারা সঙ্গমে পূজা শুরু হওয়ার এক ইতিহাস আছে। প্রথমে শুধু শাক্তমতেই পূজা হতো। একই কষ্টিপাথর থেকে বুড়োশিব, সিদ্ধেশ্বরী কালী এবং শ্যামরাইয়ের বিগ্রহ নির্মাণ করান লক্ষ্মীকান্তের সুযোগ্য নাতি বিদ্যাধর রায় চৌধুরী। বুড়োশিব ও সিদ্ধেশ্বরী কালীর বিগ্রহ হালিশহরে প্রতিষ্ঠিত হন, আর শ্যামরাই প্রতিষ্ঠিত হন মধ্য কলকাতার লালদীঘির কাছে। ১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দে, সাবর্ণরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে গোবিন্দপুর, সুতালুটা (সুতানুটি) ও কলিকাতার প্রজাস্বত্ব তুলে দিতে বাধ্য হলে শ্যামরাইকে হালিশরে স্থানান্তর করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই তিন বিগ্রহকে প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের আরাধনাকে ঘিরেই শুরু হয় পরিবারে ত্রিধারা সঙ্গম। চালচিত্রে লক্ষ্মীর পাশে থাকেন মহাদেব এবং সরস্বতীর পাশে থাকেন রাম। শিব, রাম এবং মাতৃ আরাধনা হয় এই সময় একই সঙ্গে। চালচিত্রে থাকে দশমহাবিদ্যার ছবি। সেই ছবিগুলোর মাধ্যমে সম্পূর্ণ আচার মেনে পূজিতা হন দশমহাবিদ্যা। আবার দেখা যায়, চালচিত্রে দশমহাবিদ্যার সঙ্গে সেখানে রাধা-কৃষ্ণও রয়েছে। অর্থাৎ শাক্ত মতে বলি হতো সেই রাধা-কৃষ্ণের সামনেই। 

রায় চৌধুরী পরিবারে জন্মাষ্টমীর দিন হয় কাঠামো পূজা ও রাধাষ্টমীর পুণ্য তিথিতে সেই কাঠামোয় ১০০৮ তীর্থের মাটির প্রলেপ প্রদান করা হয়। সপ্ততীর্থের জল দিয়ে স্নান করানো হয় কলাবৌকে। আটচালার পাশেই রাধামাধব মন্দির সংলগ্ন বোধন ঘরে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণানবমী তিথিতে বোধনের মাধ্যমে সূচনা হয় পূজার। বাকি সব বাড়িতে বোধন হয় ষষ্ঠীর দিন। আটচালা বাড়ির পূজার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, অষ্টমীর দিন সন্ধিপূজার সময়সীমার মধ্যেই ভোগ রান্না করতে হয়, আগে থেকে ভোগের ব্যবস্থা করা যায় না। এই ভোগে থাকে খিচুড়ি, ল্যাটা মাছ এবং কাঁচকলা পোড়া। কিছু ফুল এই পূজায় অপরিহার্য, যেমন চাঁপা, রক্তকরবী, লাল শাপলা, অপরাজিতা (নীল ও শ্বেত, দুই রকমই) ইত্যাদি। দুই বেলা মায়ের ভোগ পরম্পরাগতভাবেই বাড়ির বৌয়েরা বা মেয়েরা রান্না করেন। নবমীর দিন রাতে রান্না করে রাখা হয় ভাত (যা পান্তাভোগ হয় দশমীর), খেসারির ডাল, কচুর শাক, চালতার অম্বল আর কৈ মাছ। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হতো সিরিটি ঘাটে, আটচালা বাড়ির একটি নির্দিষ্ট ঘাটে, মা যেতেন প্রজাদের স্কন্ধারূঢ় হয়ে। প্রায় ৪০ বছর আগে, প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় দেখা যায়, ঘাটের জল অত্যন্ত নোংরা হয়ে গেছে, যার জন্য তখন থেকে মায়ের নিরঞ্জন অমন নোংরা কলুষিত জায়গায় আর না করে প্রতিবছর বাবুঘাট অথবা দই ঘাটে করা হয়। 

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দেবী আরাধনার রীতিনীতি সবই মূলত প্রায় এক। আটটি বাড়িতেই আজও মাতৃ আরাধনা হয় লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী প্রচলিত সেই একই পথে। মায়ের আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে যোগিনী, অপদেবতা এবং উপদেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য ১৮০টি মাটির খুরিতে মাষকলাই আর ঘি দিয়ে মেখে মহাষ্টমী এবং নবমীতে দেওয়া হয় মাষভক্ত বলি। বিশ্বাস, এই বলিতে সন্তুষ্ট হয়ে তারাও মায়ের পূজাতে সহযোগিতা করবেন। সাবর্ণ বাড়িতে আগে ১৩টি পাঁঠা ও একটি মোষ বলির প্রথা ছিল যা বর্তমানে বন্ধ করে তার বদলে বলি দেওয়া হয় ছাঁচি কুমড়ো বা আখ। 

সাবর্ণ বাড়ির চালচিত্রের বৈশিষ্ট্য হলো তার ত্রিভুজ আকৃতি। দেবী দুর্গার মুখ হয় পান পাতার আদলে এবং তার গায়ের রঙ হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো বা রক্তাভ তপ্ত কাঞ্চনবরন। সোনার টিপ, মুকুট, বালা, চূড়, কানপাশা, রতনচূড়, হাতপদ্ম, রতনহার, নথ ইত্যাদি এবং হিরের দুল, বিভিন্ন রত্নখচিত অলংকার, চুলের রুপার কাঁটা ইত্যাদি নানা অলংকারে দেবী সজ্জিত। এই পরিবারের বিগ্রহের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে-যেমন এখানে গণেশের গাত্রবর্ণ লাল, কার্তিক থাকেন রাজপুত্র বেশে, অসুরের গাত্রবর্ণ সবুজ। মনে করা হয়, লক্ষ্মীকান্তের গাত্রবর্ণ এবং রূপ অনুসারে কার্তিককে এমন রাজপুত্র বেশে তৈরি করা হয়েছিল। বৈষ্ণব রীতি মেনে বড় বাড়ি, মেজো বাড়ি ও নিমতা পাঠানপুর বাড়িতে সিংহের মুখ তৈরি করা হয় ঘোড়ার আদলে।

প্রত্যেকটি বাড়িতে প্রতিদিন নিয়ম করে চণ্ডীপাঠ, হোম, ভোগ, আরতি ইত্যাদি হয়। মাকে তিনবার ভোগ প্রদান করা হয়। সকালে হয় ফলের নৈবেদ্য। নানারকমের ফল দিয়ে মূল নৈবেদ্য, পূজার আরও সাত-আট রকমের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এরপর দেবীকে সাদা ভাত, খিচুড়ি, পোলাও, লুচি, নয় রকমের ভাজা, তিন রকমের তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি পঞ্চব্যঞ্জনে ভোগ নিবেদন করা হয়। মা দুর্গাকে সধবা ও বাড়ির মেয়ে বাড়িতে এসেছে-এই জ্ঞানে প্রতিদিনই ভোগে মাছ দেওয়া হয়। সাবর্ণদের পারিবারিক প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী সন্ধিপূজার সময় ল্যাটা মাছ পুড়িয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়। মাকে বাড়িতে প্রস্তুত মিষ্টান্ন দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। প্রায় ২৫ রকমের মিষ্টান্ন, যেমন সাবর্ণ প্রাণমোহিনী, সাবর্ণ দ্বিধাপ্রাঞ্জলি, ফুলবাতাসা, পুলি পিঠা, ক্ষীরের পায়েস, মিষ্টি নিমকি, গজা, মালপোয়া, লবঙ্গলতিকা দেবীকে নিবেদন করা হয়। দশমীর ভোগে থাকে পান্তাভাত, খেসারির ডাল, কচুশাক, কই মাছ, চালতার অম্বল ইত্যাদি। দেবীর জন্য আমিষ ভোগ হলেও মাঝে মহাদেব ও শ্রীরামচন্দ্রের জন্য থাকে নিরামিষ ভোগ।

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের পূজার মূল ধারা একই হলেও কোনো কোনো বাড়িতে পূজার কিছু নিয়মে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য রয়েছে। মূল নিয়ম অনুযায়ী, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজার রীতি প্রচলিত, কিন্তু বড় বাড়ির পূজার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, সপ্তমী ও অষ্টমীর সন্ধিক্ষণের প্রথম ও শেষ ২৪ মিনিট হয় অর্ধরাত্রি বিহিত পূজা। যদিও আটচালা পূজায় কুমারী পূজার চল নেই। কিন্তু দেখা যায়, বিরাটি বাড়ি আর বড় বাড়িতে নবমীতে বৈষ্ণব মতে কুমারী পূজা হয়। মেজো বাড়িতে যে কুমারী পূজার চল ছিল, তা ২০০৬ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। 

বিরাটি বাড়ি-কুমারী পূজা 

পরিবার ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। নতুন প্রজন্মকে পারিবারিক পূজার সব নিয়ম রপ্ত করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আটচালা পূজার পাশাপাশি পরিবারে আরও কয়েকটি দুর্গাপূজা করা শুরু হয়, যাতে পারিবারিক পূজার সকল আচার এবং রীতি উত্তরসূরিদের মধ্যেও বজায় থাকে। আটচালা বাড়ির পূজার পর শুরু হয় বেনাকি বাড়ির পূজা। এখানে বোধন ঘরে প্রতিদিন হোম হয়। 

বড়িশাকে রাজধানী করে তোলার অভিপ্রায়ে ১৭১৬ সালের বেশ কিছু আগেই শুরু হয়েছিল কিছু গৃহ নির্মাণের কাজ, যার মধ্যে ১৭১০ সালে বড় বাড়ির ঠাকুরদালানটিও তৈরি করা শুরু হয়। আটচালার দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার শতাধিক বছর পর ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে, বড় বাড়ির দুর্গোৎসব শুরু করেন জমিদার রায় কৃষ্ণদেব মজুমদার চৌধুরী। সবচেয়ে বড় দুর্গামন্দিরটি এখানে হলেও বর্তমানে তা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে ঠাকুরদালান সংলগ্ন জায়গাটিতে বড় বাড়ির পূজা করা হয়।

১৭১৯ সালে জমিদার দুর্গাদাস রায় চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র কৃষ্ণগোবিন্দ রায় চৌধুরী মেজো বাড়ির দুর্গাপূজা শুরু করেন, পারিবারিক রীতি অনুযায়ী, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী তন্ত্রশাস্ত্র মতে এবং সেভাবেই সব তিথি, নিয়মনীতি মেনে আজও অব্যাহত সেই পূজা। পূজা শুরুর সময় থেকে যে কাঠামো ছিল, সেই একই প্রাচীন কাঠামোয় তৈরি হয় প্রতিমা। রথের দিন কাঠামো পূজা করে, সেই দিনই তাতে খড় ও মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রতিমা তৈরির কাজও বংশ পরম্পরায় করে আসছেন মূর্তিকারেরা। এই পূজায় বলিপ্রথার প্রচলন ছিল। সপ্তমীর দিনে একটি, অষ্টমীতে দুটি, সন্ধিপূজায় একটি এবং নবমীর দিনে নয়টি ছাগশিশু বলির প্রচলন ছিল; এছাড়া লাউ, কুমড়া, শসা ইত্যাদিও বলি দেওয়া হতো। দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণী তন্ত্রশাস্ত্র মতে এই প্রথার উল্লেখ থাকলেও ২০০৬ সাল থেকে ছাগশিশু বলির প্রথাটির নৃশংসতার কথা মাথায় রেখে তা তুলে দেওয়া হয় এবং এই বলি সামগ্রী বাবদ ধার্য অর্থ দরিদ্র ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের হিতার্থে ব্যয় করা হয়। পূজার দিনগুলোতে পরিবারের সদস্য এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের জমায়েত তো হয়ই, বহিরাগত ভক্তদেরও ভোগ বিতরণ করা হয়ে থাকে। সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীতে তিথি অনুযায়ী দুবার ভোগ নিবেদন করা হয় মাকে। খিচুড়ি ভোগ, মাছ আর ৯ রকম ভাজা দিয়ে এবং পরে সাদা ভাত, পোলাও, ৯ রকমের তরকারি, ৯ রকম ভাজা, দু-তিন রকমের মাছ দিয়ে মায়ের ভোগ দেওয়া হয়। এই ভোগের সম্পূর্ণ দায়িত্বে থাকেন বাড়ির মেয়ে-বউরা। পরিবারের নিজস্ব, বড়পুকুর বলে জলাশয়ে মায়ের নিরঞ্জন সম্পন্ন হয়। 

১৭৩৫ সাল থেকে শুরু হয় কালিকিংকর ভবনের দুর্গাপূজা। সেখানেও মূল ধারা বজায় রেখেই প্রতিবছর হয়ে আসছে দেবীর আরাধনা।

বিরাটি বাড়ির পূজায় নবপত্রিকার এবং মা দুর্গার আলাদা আলাদা নৈবেদ্য হয়, এছাড়া সব ঠাকুরের আলাদা একটি ভোগ দেওয়া হয়। সপ্তমী থেকে দশমী, প্রতিদিনই নিয়ম অনুযায়ী মাছ ভোগ দেওয়া হয়। সকালে মাকে ফল, মিষ্টান্ন, নাড়ু, মাখন, মিছরি, মিছরির শরবত ইত্যাদির ভোগ দেওয়া হয়। সন্ধ্যাবেলা লুচি, আলু চচ্চড়ি, সুজি, মিষ্টি, নাড়ু-এসব নিবেদন করা হয়। বিরাটি বাড়ির এয়োস্ত্রীরা নবমীতে মাথায় ও হাতে ধুনো নিয়ে ধুনো পোড়ান। যারা ধুনো পোড়াচ্ছেন, তাদের কোলে গিয়ে যারা বসবে, মা তাদের নীরোগ করবেন, ভালো রাখবেন-এই বিশ্বাস। 

নিমতায় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের পূজা হয় নবীন-কিরণ ভবনে। সেখানে সম্পূর্ণ পূজাটাই হয় বৈষ্ণব মতে। আমিষের কোনো ছোঁয়াই চলে না সেই পূজায়। এই বাড়িতে ষষ্ঠীর অধিবাসের সময় আকবরি মোহর দিয়ে মাকে বরণ করা হয়। সন্ধিপূজার সময় এখানে সাবর্ণদের কুলদেবী মা ভুবনেশ্বরীর বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয় ও এই সময় ক্ষীরের পুতুল বলি দেওয়া হয়।

দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে থাকা রায় লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার চৌধুরীর বংশধরেরা দুর্গাপূজার পাঁচটি দিন চেষ্টা করেন যেভাবেই হোক, পরিবারের এই আটটি পূজাতেই জমায়েত হতে। মায়ের আগমন হয়ে ওঠে পারিবারিক মিলনোৎসব। সাবর্ণ পরিবারের প্রায় সবাই চেষ্টা করেন পূজার কটা দিন এই পুজোগুলোয় কোনো না কোনোভাবে উপস্থিত থাকতে। 

কনকাঞ্জলির মাধ্যমে দশমীতে দেবীর বিসর্জন হয়। দশমীর দিন বাড়ির সব থেকে বয়োজ্যেষ্ঠা এয়োস্ত্রীকে সিঁদুর দিয়ে শুরু হয় সিঁদুর খেলা। ঘট বিসর্জন হয়ে গেলে মণ্ডপেই দেবী প্রতিমার সামনে গুরুজনদের প্রণাম করার ও বিজয়া পর্ব সারার রীতি আছে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে। পূজা শেষে মা ফিরে গেলে, সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের প্রতিটি সদস্য অপেক্ষা করতে থাকেন আগামী বছর মায়ের আগমনীর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //