সাতজন যুবক, একটি গুহা আর তিন শতাব্দীর নিদ্রা

অন্ধকার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থা থেকে পালিয়ে আসা সাতজন যুবক, একটি গুহা আর তিন শতাব্দীর নিরবচ্ছিন্ন নিদ্রার ঘটনাই আসহাবে কাহাফ নামে সুপরিচিত। কেবল মুসলিম নয় বরং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কাছেও খুব জনপ্রিয় ও অলৌকিক ঘটনা এটি। 

কোরআনে বর্ণিত ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। পবিত্র কোরআনের ১৮ নম্বর ‘সুরা কাহাফ’ মক্কাতে অবতীর্ণ হয়। এ সুরা সম্পর্কে তাফসিরে ইবনে কাসিরের এক তাফসিরে লিখিত আছেযে অত্যাচারী শাসকের তাড়ায় যুবকেরা পালিয়ে যায়, তার নাম ছিল দাকইয়ানুস। তা ছাড়া যে কুকুরটি তাদের সঙ্গে ছিল, সেটি রাজবাবুর্চির কুকুর ছিল, কুকুরের নাম কিতমির। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নিশ্চিত করে বলেন যে, গুহাবাসীর সংখ্যা সাতজনই ছিল। কোনো কোনো মতে তাদের নাম ছিল মুকসালমিনা, তামলিখা, মারতুনিস, সানুনিস, সারিনুনিস, যুনিওয়াস, কাস্তিতিউনিস। তবে নামগুলোতে রোমান নামের আরবিকরণের এক ছাপ রয়েছে।

এবার ফেরা যাক সিরিয়ান লোককথায়। পঞ্চম শতকের সিরিয়ান বিশপ জ্যাকব অব স্যারাগ এই ঘটনার বর্ণনা দেন। এ কাহিনিমতে, আড়াইশ সালের দিকে রোমান সম্রাট ডিসিয়াসের শাসনকালে (২৪৯-২৫১) সাতজন তরুণ ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান যুবককে ধর্মত্যাগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদেরকে জোরপূর্বক দেবদেবীদের বিশ্বাসে ফিরে যেতে সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের সকল সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এরপর তারা পালিয়ে যান অক্লন পাহাড়ের এক গুহায়। সেখানে প্রার্থনা শেষে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। বলা আছে, গুহার খবর পাওয়ার পর সম্রাট সেই গুহা সিলগালা করে দেন, যেন তারা ক্ষুধায় মারা যান।

এদিকে গুহাবাসী যুবকদের এক ঘুমে কেটে যায় কয়েকশ বছর। এর মাঝে পৃথিবীতে রাত দিনের পরিবর্তন, উত্থান-পতনের কোনো আঁচ তারা অনুভব করলেন না। গভীর নিদ্রায় তিনশ নয় বছর পাড়ি দিলেন তারা। 

বর্ণনা মোতাবেক, সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াসের (৪০৮-৪৫০) আমলে, গুহার সিলগালা ধ্বংস করা হয়। যিনি খুলেছিলেন, তিনি ওটাকে গোয়ালঘর বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি ভেতরে সাতজন যুবক ঘুমিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে যুবকেরা ঘুম ভেঙে উঠে ভাবলেন একটি পুরো দিন তারা ঘুমিয়ে ছিলেন। তাদের একজনকে বাজারে পাঠানো হলো, সাবধানে বাজার করতে বলা হলো যেন কেউ চিহ্নিত করতে না পারে। শনাক্ত হয়ে গেলে অত্যাচারী রাজার পৌত্তলিক অনুসারীরা তাদের গ্রেপ্তার করবেন। কিন্তু শহরে গিয়ে যুবক বিস্মিত! আশপাশে ক্রুশ লাগানো দালানকোঠা, লোকে প্রকাশ্যেই যিশুর নাম করছে! এমন সময়ে দোকানি তার দেওয়া মুদ্রাও ফিরিয়ে দিলেন অনেক পুরনো ডিসিয়াসের আমলের মুদ্রা বলে।

বিশপ তাদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলেন। ধর্মপ্রাণ সম্রাট নিজে এসে তাদের সঙ্গে কথা বললেন ও অনেক কিছু করতেও চাইলেন, কিন্তু তারা সেসবে কর্ণপাত না করে ফের গুহায় ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন এবং এক সময় সবাই মারা গেলেন। অর্থোডক্স খ্রিষ্টান চার্চ এই সাত মহাপ্রাণকে বছরে দুদিন স্মরণ করে ভোজের আয়োজন করে আগস্ট ৪ এবং অক্টোবর ২২ তারিখে।

কোরআনে যে এফিসাস শহরের ঘটনার কথা বলা হয়েছিল সে বিষয়ে স্কলারগণ একমত। তবে ট্র্যাডিশনের জায়গা থেকে কিছু হেরফের হলেও অধিকাংশই মিলে যায়। দুটো ঘটনাই নিশ্চিত করে যে, সে সময় একজন অত্যাচারী শাসক ছিলেন। 

তুরস্কের এফিসাস শহরের বাইরের সেই গুহা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ১৯২৭-১৯৩০ সালের দিকে  ২ হাজার টেরাকোটা ল্যাম্প পাওয়া যায়, যেগুলো চার্চের জন্য উৎসর্গ করা ছিল। কার্বন ডেটিংয়ে সেগুলো চতুর্থ বা পঞ্চম শতকের বলে মনে করা হয়। যেটির অর্থ সেখানে চার্চ বানিয়েছিল স্থানীয়রা। ল্যাম্পগুলোর গায়ে ছিল ক্রুশের ছবি, কোনো কোনোটার গায়ে ছিল আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে তাওরাতের মহারথীদের ছবি। যেমন- ইব্রাহিম (আ.), ইসহাক (আ.) এবং সিংহের গুহায় দানিয়েল (আ.)। আর এগুলোর পাশে হারকিউলিস ও সিংহ, জিউস ও আফ্রোদিতি, মন্দিরের ছবি ও দেবতা আত্তিসের মাথার ছবিও ছিল। 

বর্তমানে তুরস্কের শহরটির কিছুটা বাইরেই গুহাটির দেখা মিলবে। তবে জর্ডানের আম্মানের কাছেও ১৯৬৩ সালে আরেকটি জায়গাকে আসহাবে কাহাফ বলে দাবি করা হয়। সেটিকে আল রাকীম বলা হয়ে থাকে। তবে স্থানীয় বর্ণনা ছাড়া কোনো ঐতিহাসিক সূত্র এ বিষয়ে আর পাওয়া যায়নি, যেটির সঙ্গে সেভেন স্লিপার্সের  (খ্রিষ্টান ধর্মমতে) ঘটনার সাদৃশ্য রয়েছে। 

এ সব ছাড়াও তুরস্কের আম্মুরিয়াগ হায হামজা, টারসাস, মিশরের কায়রোতে, এমনকি উত্তর আফ্রিকা কিংবা চীনের অনেক স্থানকেও আসহাবে কাহাফের জায়গা বলে দাবি করা হয়। মূলত পেছনের কাহিনি না জেনে হরহামেশা ধর্মীয় রেলিক পাওয়ার দাবিদাওয়ার কারণেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এ রকম দেখা যায়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //