ইয়া আলি! ইয়া হোসেন! গগন বিদারী মাতমে তাজিয়া মিছিল পেরিয়ে যায় মুহূর্তেই, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের স্মরণে লাল-সবুজ পোশাক পরিধান করেছেন মিছিলের কেউ কেউ, বাচ্চারা ঢোল নিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে তাজিয়া মিছিলের অনুকরণে। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের দৃশ্য এটি। তখন মহররমের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। ক্যাম্পের স্যাঁতসেঁতে-দুর্গন্ধময় গলিগুলো ধরে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়ে মহররমকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ। সেখানে ইমামের বাড়ি হিসেবে পরিচিত ইমামবাড়াগুলো রঙিন আলোয় সজ্জিত। সামনে উড়ছে লাল আর সবুজ পতাকা, আসরের নামাজের পর মসজিদ থেকে ইমামের কণ্ঠে ভেসে আসছে মহররমের তাৎপর্য বর্ণনা।
জেনেভা ক্যাম্পের নয় নম্বর সেক্টরের জয়নাল হোটেলের মোড় সংলগ্ন ইমামবাড়ার সামনে বসে থাকতে দেখা গেল, খলিফা হাজী মোহাম্মদ আফরোজকে। সঙ্গী হাফেজ আব্দুর রহিম। তাজিয়া মিছিল ও মহররম সম্পর্কে এই ইমামবাড়ার খলিফা আফরোজ জানালেন, ‘মহররমের চাঁদের এক তারিখ থেকে তাজিয়া মিছিল, লঙ্গরখানায় গরিব-মিসকিন খাওয়ানো, দোয়াদরুদ পাঠ চাঁদের বারো তারিখ পর্যন্ত চলে। অনেকে আবার মানত করে মাছ, শাক-সবজি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন এ সময়।
বাংলাদেশে ঠিক কত সাল থেকে তাজিয়া মিছিল বের হতো তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার লেখা ‘ঢাকা সমগ্র’ বইতে লিখেছেন, ‘ধরে নিতে পারি মুঘল আমলে সতেরো শতকে বাংলাদেশে প্রচলন হয়েছিল মহররমের, বিশেষ করে ঢাকায়।’
মুনতাসীর মামুন আরও অনুমান করছেন যে, ‘গ্রামাঞ্চলেও তখন হয়তো কোথাও কোথাও পালিত হতো। তবে তিনি মনে করেন গ্রামাঞ্চলে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল উনিশ শতকে। মহররম নিয়ে গ্রামাঞ্চলে পুঁথি রচিত হতো। সেসব পুঁথি বছরের অন্যান্য সময় তো বটেই, মহররমের মাসে তা নিয়মিত সুর করে পড়া হতো। তিনি অনুমান করেন, ‘মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু প্রকাশের পর বাংলাদেশে নতুন মাত্রা পেয়েছিল মহররম।’
সুন্নি সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল
মহররম আর তাজিয়া মিছিল প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে ‘শিয়া সম্প্রদায়’-এর নাম এসে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো পোশাক পরিহিত একদল মানুষ, ‘হায় হোসেন’ মাতম তুলে দড়িতে বাঁধা একগুচ্ছ ধারালো ছোরা দিয়ে নিজের পিঠে সজোরে আঘাত করছেন। কিন্তু আফরোজদের সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল বা মাতম এমন নয়। এই লেখার শুরুতে যে তাজিয়া মিছিলের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা আফরোজদেরই। তিনি বলেন, “আমরা সুন্নি আল জামাত-আহলে বাইত। তাজিয়া মিছিলে আমরা বলি ‘ইয়া আলি-ইয়া হোসেন’। পোশাকও নির্দিষ্ট নয়। কেউ হয়তো ইমাম হোসেনের স্মরণে লাল পরে এলো আবার কেউ ইমাম হাসানের স্মরণে সবুজ।” আফরোজের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন হাফেজ আব্দুর রহিম ইমামবাড়ায় বসে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। মহররমের চাঁদের এক তারিখ থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত এভাবেই পড়ে যাবেন তিনি, তারপর সম্মিলিত মোনাজাত হবে এখানে। এটাই নিয়ম।
ঢাকায় মহররম পালন প্রসঙ্গে ‘ঢাকা সমগ্র’-তে বলা হয়েছে, ‘এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সুন্নি, মহররমের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ক্ষীণ, যারা গোঁড়া সুন্নি তাদের কাছে মহররমের অনেক আচার পৌত্তলিকতার শামিল।
শিয়া সম্প্রদায় ও মহররম
শোকাবহ কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার স্মরণে আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিল বের করে শিয়া সম্প্রদায়। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা সমগ্র’র তথ্য অনুযায়ী শাহ সুজার সুবাদারি আমলে বাংলায় শিয়ারা আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিলেন। সুজা নিজে সহানুভূতিশীল ছিলেন শিয়াদের প্রতি। তার আমলে প্রধানত ইরান থেকে অনেক শিয়া পরিবার ভাগ্যান্বেষণে চলে এসেছিল বাংলায়। তারা লাভ করেছিলেন রাজপদ, ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্জন করেছিলেন বিত্ত এবং নিজেদের উন্নীত করতে পেরেছিলেন অভিজাত পর্যায়ে। বাংলার নায়েবে নাজিমরা ছিলেন শিয়া। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে শিয়া আধিপত্য হয়ে উঠেছিল প্রবল-ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও হুগলিতে। বাংলাদেশের ঢাকা ছিল মহররম পালনের প্রধান কেন্দ্র। কারণ ঢাকা ছিল নায়েবে নাজিমদের বাসস্থান, প্রশাসনিক কেন্দ্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শহিদুল হাসান ‘বাংলায় মহররম তাজিয়া’ শীর্ষক এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিবি কা রওজাকে ঢাকার প্রথম ইমামবাড়া হিসেবে চিহ্নিত করেন প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানি। ১০১১ হিজরিতে (১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) নির্মিত ইমামবাড়াটি আমির খান নামে একজন নির্মাণ করেন। আরএম দোসানজি ১৮৬১ সালে সংস্কার করেন। এ ছাড়া ১৮৬৯ সালের মানচিত্রে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে আরেকটি পুরনো ইমামবাড়া দেখা যায়। এর বাইরে ফুলবাড়িয়ার কাছে ছিল মীর ইয়াকুবের হোসেনী দালান। ছোট কাটরা ও মুকিম কাটরাতে ছিল আরও দুটি ইমামবাড়া।
মহরমের দিন হোসেনী দালান থেকেই এখন শিয়াদের সবচেয়ে বড় তাজিয়া মিছিল বের হয়। বুক চাপড়ে কান্নার মাতম ধ্বনি তুলে মিছিলটি চকবাজার, লালবাগ, উর্দু রোড, আজিমপুর-নিউমার্কেট হয়ে ধানমন্ডিতে গিয়ে শেষ হয়। তাজিয়া মিছিলে শোকের প্রতীক হিসেবে খালি পায়ে পুরুষরা কালো পাঞ্জাবি-পাজামা এবং নারীরা কালো কাপড় বা বোরকা পরে অংশ নেন। হোসেনী দালান ছাড়াও মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বকশীবাজার, লালবাগ, ফরাশগঞ্জ, পল্টন, মগবাজার থেকেও তাজিয়া মিছিল বের হয়।
হোসেনী দালানের পরে দেশে বড় তাজিয়া মিছিল বের হয় মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃত্থিমপাশা থেকে। তিন শতকের বেশি সময় ধরে পৃত্থিমপাশা নবাব বাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় শিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠী সেখানে মহররম পালন করছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh