Logo
×

Follow Us

প্রতিবেদন

মহাসাগরের প্লাস্টিক দূষণ হুমকিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১১:০৯

মহাসাগরের প্লাস্টিক দূষণ হুমকিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

আমাদের পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ জলরাশি, অর্থাৎ সাগর-মহাসাগর দ্বারা আবৃত। এই সাগর ও মহাসাগরগুলো শুধু জলজ প্রাণীর আবাসস্থল নয়, বরং আমাদের আবহাওয়া, খাদ্য সুরক্ষা এবং জীবিকার মূল চালিকাশক্তি; কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো সাগরে প্লাস্টিক দূষণ, যা ধীরে ধীরে এই নীল জলরাশিকে গ্রাস করছে। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল, প্যাকেজিং প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক আমাদের বাস্তুতন্ত্রের জন্য এক নীরব হুমকি।

এ কথাও ঠিক যে, প্লাস্টিক নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী উপাদান। হালকা, মজবুত, সস্তা এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

বোতল, ব্যাগ, প্যাকেজিং, খেলনা, ইলেকট্রনিকস সব কিছুতেই প্লাস্টিকের ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু এই দীর্ঘস্থায়ী বৈশিষ্ট্যই এর সবচেয়ে বড় অভিশাপ। প্লাস্টিক সহজে পচে না; একটি প্লাস্টিক বোতল সম্পূর্ণ পচে যেতে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।

সাগরে প্লাস্টিকের দূষণের ভয়াবহতা

প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ আমাদের অপরিকল্পিত জীবনযাপন এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বিশ্বে প্রতি বছর যে ৩০০ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, তার প্রায় অর্ধেকই হলো একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক। এর মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করা হয়। 

বাকি বিশাল অংশ পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (টঘঊচ) তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ১১ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক সমুদ্রে প্রবেশ করে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২৯ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। ফলে ভবিষ্যতে মহাসাগরের মোট প্লাস্টিকের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়ন টনে পৌঁছে যেতে পারে।

বর্তমানে আমাদের মহাসাগরে আনুমানিক ১৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক রয়েছে। এই বর্জ্য সমুদ্রে ভাসমান মোট বর্জ্যরে প্রায় ৮০ শতাংশ। বছরের পর বছর ধরে প্লাস্টিক জমতে জমতে মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশাল আকারের বর্জ্যরে স্তূপ বা ‘প্যাচ’ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ। এর আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১০ গুণেরও বেশি!

অদৃশ্য বিপদ মাইক্রোপ্লাস্টিক 

সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, মহাসাগরের মোট প্লাস্টিকের প্রায় ৯২ শতাংশই হলো মাইক্রোপ্লাস্টিক। এগুলো হলো প্লাস্টিকের ছোট ছোট কণা (পাঁচ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট)। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত বড় প্লাস্টিক ভেঙে বা বিভিন্ন প্রসাধনী, সিনথেটিক পোশাক থেকে বের হয়ে সমুদ্রে মেশে। এক গবেষণা বলছে, বর্তমানে সমুদ্রে প্রায় ১৫ থেকে ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা রয়েছে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো এতটাই ছোট যে, এদের সরিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব।

প্লাস্টিক কীভাবে সমুদ্রে পৌঁছায়

প্লাস্টিক সরাসরি সমুদ্রে ফেলা হতে পারে, তবে এর বেশির ভাগই স্থলভাগ থেকে আসে। নদীগুলো প্লাস্টিক দূষণের প্রধান বাহক। গঙ্গা, সিন্ধু, ইয়াংসি, মেকং, নাইজারসহ বিশ্বের ১০টি উল্লেখযোগ্য নদী বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক প্লাস্টিক দূষণের প্রায় ৯০ শতাংশ এর জন্য দায়ী। বৃষ্টি, বাতাস ও বন্যার কারণে প্লাস্টিক আবর্জনা স্থলভাগ থেকে নদীতে ভেসে যায় এবং নদীগুলো সেগুলোকে সমুদ্রে নিয়ে যায়। এ ছাড়াও পর্যটনশিল্প এবং উপকূলীয় শহরগুলোর বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে পতিত হয়।

পরিবেশ এবং প্রাণিজগতে প্রভাব

পরিত্যক্ত মাছ ধরার জাল বা ‘ঘোস্ট নেট’ এবং অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্যে ডলফিন, তিমি, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও সীলের মতো বড় প্রাণীরা জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে তারা শ্বাস নিতে পারে না, আহত হয় বা খেতে না পেরে মারা যায়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায় এই ফিশিং গিয়ারে আটকা পড়ে।

ছোট মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, এমনকি প্রবালও মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলোকে খাদ্য হিসেবে ভুল করে গিলে ফেলে। প্লাস্টিক তাদের হজমতন্ত্রে জমা হয়ে পেট ভরে থাকার ভুল ধারণা তৈরি করে, ফলে তারা অপুষ্টিতে ভোগে বা অভ্যন্তরীণভাবে আহত হয়। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, গভীর সমুদ্রের প্রাণীদের পাকস্থলীও প্লাস্টিকে ভর্তি।

প্লাস্টিক কণাগুলো সমুদ্রের জলে থাকা অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ (যেমন-কীটনাশক, চঈই এবং উউঞ) শুষে নেয়। যখন কোনো সামুদ্রিক প্রাণী সেই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে তখন বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো তাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং খাদ্য শৃঙ্খল ধরে ওপরের দিকে যেমন-মাছ মানুষের মাঝে চলে আসে।

প্লাস্টিক রাসায়নিকভাবে স্থিতিশীল হলেও এটি যখন সমুদ্রে ভেঙে যায়, তখন এর থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এই রাসায়নিক পদার্থগুলো সামুদ্রিক প্রাণীদের হরমোন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দিতে পারে।

মানব স্বাস্থ্যঝুঁকি

গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে। আমরা যে মাছ, চিংড়ি বা শামুক খাই, তার প্রায় ৬০ শতাংশের দেহেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষণা বলছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বছরে গড়ে দুই লাখ ১১ হাজার পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা মানুষের ফুসফুস, রক্ত, প্ল্যাসেন্টা, এমনকি মস্তিষ্কেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। প্লাস্টিক কণার কারণে মানুষের শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, প্রদাহ এবং বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। প্লাস্টিকের নির্মাণে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক পদার্থ (যেমন-এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর) হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে পারে, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

প্রতিকারে আশার আলো 

এই মহাবিপর্যয় মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। ‘দি ওশান ক্লিনআপ’-এর মতো সংস্থাগুলো ভাসমান বাঁধ ও বিশেষ ইন্টারসেপ্টর ব্যবহার করে নদীপথে প্লাস্টিক আটকাচ্ছে, যাতে সেগুলো সমুদ্রে পৌঁছাতে না পারে। বিজ্ঞানীরা এমন এনজাইমও (যেমন-চঊঞঅঝঊ) তৈরি করেছেন, যা প্লাস্টিককে দ্রুত ভেঙে দিতে পারে। নাসার স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের উপরিভাগে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব চিহ্নিত করা হচ্ছে, যা পরিষ্কারের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। ‘গ্রেট বাবল ব্যারিয়ার’-এর মতো ব্যবস্থা নদীতে বুদবুদ ব্যবহার করে প্লাস্টিককে ওপরে তুলে এনে সংগ্রহ করছে। এই প্রচেষ্টাগুলো আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। 

আমাদের করণীয়

বর্জ্য সংগ্রহ, পুনর্ব্যবহার এবং সঠিক নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।

প্রসাধনী পণ্যে মাইক্রোবিডসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং সিন্থেটিক পোশাক ধোয়ার সময় মাইক্রোফাইবার নির্গমন কমানোর জন্য ফিল্টার ব্যবহার করা। নদীগুলোকে প্লাস্টিকমুক্ত রাখতে হবে, কারণ এগুলোই প্লাস্টিককে সমুদ্রে বয়ে নিয়ে যায়। সরকারগুলোকে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ভর্তুকি এবং প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে।

প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে বায়োডিগ্রেডেবল এবং কম্পোস্টেবল উপকরণের উদ্ভাবন এবং প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় নতুন প্রযুক্তির গবেষণা।

প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটিতে শিক্ষামূলক কর্মসূচির আয়োজন করা। শিশুদের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্লাস্টিক দূষণ একটি সীমান্তহীন সমস্যা, তাই এর সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। দেশগুলোকে একত্রিত হয়ে একটি বৈশ্বিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে, যা প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সাহায্য করবে।

জটিল ও বহুমাত্রিক এই সমস্যা সমাধান শুধু আইন বা প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত সচেতনতা, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী নিশ্চিত করতে হলে এখনই এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫