গবেষণা খাতে ব্যয় কমছে বিশ্ববিদ্যালয়ে

দেশের অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কাজ; কিন্তু তাতে নেই প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ। সাম্প্রতিক এক ব্যয় পর্যালোচনায় এমন দশা উঠে আসে। 

সর্বশেষ ২০১৯ সাল ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৬তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে দেশের ১২৫টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বমোট মাত্র ১৫৩ কোটি টাকা গবেষণায় ব্যয় করেছে। অর্থাৎ প্রত্যেকের গড় বার্ষিক খরচ ছিল ১ কোটি ২২ লাখ টাকা। এটা তাদের সব প্রকার খরচের তুলনায় মাত্র ১ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ স্বল্প ব্যয়ে বিশাল মূল্য দিচ্ছে দেশ। বিশেষজ্ঞরা জানান, এ কারণেই ২০২০ সালে গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে মন্দ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। 

জ্ঞানচর্চার বৈশ্বিক এ সারণি তালিকায় বাংলাদেশ ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম স্থান অধিকার করে। ফলে দেশের জ্ঞান উন্নয়নের অবকাঠামো যে কি চরম দুর্বল- সেই চিত্র যেন নতুন করে উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক সারণিতে সেই অবস্থান দশমিক ৯ পয়েন্ট বেড়ে ৩৫.৯ পয়েন্টে উন্নীত হয়। যদিও তা বৈশ্বিক গড় ৪৬.৭ এর চেয়ে কম।

শুধু গবেষণায় কম জোর দেওয়ার কারণেই সারণির ‘উন্নয়ন ও উদ্ভাবন’ সূচকে ১০০ এর ভেতর মাত্র ১৬.৪ পয়েন্ট পায় বাংলাদেশ। যে কারণে শিক্ষার অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের তুলনামূলক ভালো স্কোর করার সম্ভাবনা নষ্ট হয়।

মোট ১০০টির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব-শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শিক্ষা সহযোগী পরিবেশের মতো সূচকে বাংলাদেশ ৪০-এর বেশি স্কোর অর্জন করে। তবুও উচ্চশিক্ষা গবেষণায় অবহেলা দুর্বল করেছে দেশের সার্বিক অবস্থান। 

চরম নাজুক এই হালচিত্র তুলে ধরে যোগাযোগ করা হলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তারা এখন থেকে গবেষণা খাতে খরচ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেন। 

কে কত খরচ করছে : ইউজিসি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবেষণা) ব্যয় ছিল ৫৩ কোটি টাকা বা গড়ে ১ কোটি ৪০ লাখ করে। অন্যদিকে বেসরকারি ৮৭টি বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজে খরচ করেছে ১০০ কোটি বা গড়ে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। একই বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকর্মীদের বেতনভাতাসহ সার্বিক ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। 

গবেষণায় গড় খরচের অঙ্কে সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারির চেয়ে এগিয়ে থাকলেও মোট খরচের বিপরীতে গবেষণা কাজে বরাদ্দের অনুপাত তুলনা করা হলে বিপরীত চিত্রের দেখা মেলে। প্রতিটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মোট বাজেটের ১.১৪ শতাংশ ব্যয় করেছে গবেষণায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ অনুপাত ছিল ২.৯৬ শতাংশ। 

এছাড়া সাম্প্রতিক প্রকাশিত ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে শীর্ষ ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ব্যয় করেছে ৮২ কোটি টাকা। তার বিপরীতে শীর্ষ ১০ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিনিয়োগ করেছে মাত্র ৩২ কোটি টাকা।

সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা হলো, ২০১৯ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় যে অর্থ ব্যয় করেছে, তা ছিল শীর্ষ ১০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা মোট গবেষণা ব্যয়ের চেয়ে ৫ কোটি টাকা বেশি।

বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯টিতে শিক্ষাবর্ষ এখনো শুরু হয়নি। এর মধ্যে আদালতের নির্দেশে বন্ধ হয়েছে তিনটি, অপর ছয়টি ২০১৯ সালে কোনো গবেষণার উদ্যোগ নেয়নি। ইউজিসি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণা করেনি। 

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশের উচ্চতর শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে গবেষণা ব্যয়ের পরিমাণ খুবই কম এবং এ ধরনের অপর্যাপ্ত গবেষণা উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্যও বয়ে আনবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার মাধ্যমে নতুনতর জ্ঞান উৎপাদন করে বিশ্বকে সমৃদ্ধ করার কেন্দ্র; কিন্তু দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফলদায়ক কোনো গবেষণা করছে না, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। 

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের মৌলিক গবেষণা কাজ করা দরকার আর সে জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দও প্রয়োজন; কিন্তু দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ পায় না, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ব্যয় বাড়াতে কুণ্ঠিত বোধ করে।’ 

দেশে গবেষণার পরিধি ও মান উন্নয়নে এখন বিপুল বরাদ্দ দরকার বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘তবে কোনো ইউনিভার্সিটিই যথেষ্ট মাত্রায় গবেষণা বিনিয়োগ করছে না। তাই আমি উত্তরণের কোনো আশাও দেখছি না।’

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণায় জোর দেওয়া এবং তার মধ্য দিয়ে মানসম্মত শিক্ষায় জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পেছনে যথাযথ বিনিয়োগ না করেই বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে দক্ষ মানবশক্তি উৎপাদন করবে?’ গবেষণা ব্যয়ের অপ্রতুল বরাদ্দের কথা উল্লেখ করে তিনি এ প্রশ্নও রাখেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //