প্রতিরক্ষা খাতে বিভ্রান্ত ভারত

আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারের অন্যতম শীর্ষ ক্রেতা ভারত; কিন্তু দেশটি এখন আমদানি করা অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে চাইছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। 

সম্প্রতি প্রতিরক্ষা সমগ্রী উৎপাদন ও অধিগ্রহণ সংক্রান্ত দুটি খসড়া পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে এরই মধ্যে শতাধিক অস্ত্র আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। এসব উদ্যোগ স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের জন্য আনন্দদায়ক হলেও তাদের মধ্যে তেমন কোনো উল্লাস দেখা যাচ্ছে না। 

বরং এই মুহূর্তে তারা খানিকটা দ্বিধান্বিত। কারণ একদিকে সরকার স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন বাড়াতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট খাতটিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ফলে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে বিদেশি বিনিয়োগাকরীদের মালিকানা আরো বাড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

গত মে মাসে অধিগ্রহণ নিয়ে একটি খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতকে সামরিক সামগ্রী ম্যানুফ্যাকচারিং ও রফতানির কেন্দ্রস্থল হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়ে সম্প্রতি স্থানীয় উৎপাদন সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালাও উন্মোচিত হয়েছে। 

  • (ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, যে কেউ বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর এসব কোম্পানি ভারতের বাইরে থেকেও যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী যোগ করতে পারবে। এমনকি যেসব পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কোনো উৎপাদনকারীর যদি ভারতে সাবসিডিয়ারি থাকে, তাহলে তারা এসব পণ্য ভারতেই নানাভাবে তৈরি করতে পারবে। এ বিষয়টিকে পেছনের দরজা দিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রবেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে...)

স্থানীয় প্রতিরক্ষা খাতকে আরো উদ্দীপ্ত করে তুলতে ভারতীয় সরকার যেসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তারমধ্যে শতাধিক ধরনের অস্ত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা অন্যতম।

 প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এ সংক্রান্ত ঘোষণায় জানান, ‘আর্টিলারি গান, রাইফেলের গুলি ও পরিবহন বিমানসহ মোট ১০১ ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা চলতি বছর থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। আত্মনির্ভর ভারত উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।’

অ্যাসোসিয়েটেড চ্যাম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া সেক্রেটারি জেনারেল দীপক সুদ বলেন, ‘অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক ব্যবস্থার বড় আমদানিকারকদের মধ্যে ভারত অন্যতম। ফলে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি শুধু অর্থনৈতিকভাবে বিশাল সুযোগই দেবে না, ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধাও পাবে ভারত।’

তবে চলতি বছর সামরিক খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ সীমা ৭৪ শতাংশে উন্নীত করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। এর ফলে বিদেশি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো খুব সহজেই স্থানীয় সাবসিডিয়ারি গঠন করতে পারবে। এটি ভারতের পুরো সামরিক খাতের জন্য বিতর্কিত বিষয় বলে মনে করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ইকোনমিকস ল’স প্র্যাকটিসের সহকারী পরিচালক কারিশমা মনিয়ার বলেন, ‘সামরিক খাত স্বদেশীকরণের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার, রফতানি নীতিমালাও এ লক্ষ্যে করা হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনার বিষয়ে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা নেই।’

সরকারের এ উদ্যোগকে ভারতের বেসরকারি সামরিক সামগ্রী নির্মাতা কোম্পাানিগুলো জনসম্মুখে প্রশংসা করলেও ভেতরে ভেতরে তারা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে নানারকম আইন-কানুন, নীতিমালা এবং নিয়ম তাদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। প্রতিরক্ষা খাত থেকে সরকার ঠিক কি চাইছে এ বিষয়টি খোলাসা করা প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুরু থেকেই অন্তত মুখে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে স্থানীয় প্রতিরক্ষা খাতকে স্বনির্ভর করে তোলার কথা বলে আসছেন। তবে হতাশার কথা হলো- গত পাঁচ বছরে তার প্রশাসন স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে বড় কোনো ক্রয়াদেশ দেয়নি। বরং রাফাল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের জন্য ফরাসি সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে ভারত। অথচ এর আগে সম্পন্ন চুক্তিতে এসব যুদ্ধবিমান ভারতেই নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছিল দিল্লি। এছাড়া চীনের সাথে সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যেই রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়ের চুক্তি করেছে ভারত। মূলত উৎপাদন, অধিগ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ- এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে অস্ত্রে স্বনির্ভর হতে ভারত সরকার এগিয়ে যাচ্ছে।

উৎপাদন

স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন নীতিমালা নিয়ে ভারতীয় সরকার এ পর্যন্ত দুটি খসড়া প্রকাশ করেছে। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। আর ‘ড্রাফট ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রমোশন পলিসি’ নামে নতুন খসড়াটি কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে। নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, ১০১ ধরনের সামরিক পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ২০২০ এবং ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে ৬৯টি পণ্যে নিষেধাজ্ঞা চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে এবং বাকিগুলো ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। 

তবে টাটা পাওয়ার স্ট্র্যাটেজিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জিটিএম কনসাল্টিং প্রাইভেটের চেয়ারম্যান রাহুল চৌধুরী জানান, নিষেধাজ্ঞার আওতায় যেসব পণ্য রয়েছে, তার বেশিরভাগই ৯০ শতাংশ দেশীয় কাঁচামালে সরকারিভাবে তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও মনে করেন, সরকারের এই উদ্যোগটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ লক্ষ্যের শক্তিকে হ্রাস করে দিবে। এটি মূলত নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আগে পর্যন্ত এসব পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ক্রয়ের একটি বৈধ স্বীকৃতি দিয়ে দিল। 

এদিকে, খসড়া উৎপাদন নীতিমালায় ২০২৫ সালের মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্যাটেলাইট ও সামরিক সরঞ্জাম থেকে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর বার্ষিক টার্নওভার এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি রুপিতে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যার মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি রুপির রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে স্থানীয় অস্ত্র কোম্পানিগুলোর টার্নওভার এক লাখ ৪০ হাজার কোটি রুপিতে পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। 

অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা এসব পরিকল্পনাকে অসম্পূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তারা বলছেন, মূলত আগের সব নীতিমালাই এখানে এক করে রাখা হয়েছে এবং লক্ষ্যমাত্রাতেও কোনো হেরফের নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি রুপি বার্ষিক রাজস্ব অর্জিত হলে তা হবে বর্তমানের ৭০ হাজার কোটি রুপি টার্নওভার থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। আর এটি অর্জন করতে হলে বাজেটে কমপক্ষে ৮-১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। অথচ সরকারি কোম্পানিগুলো বার্ষিক ৫ থেকে ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার বাকি প্রবৃদ্ধিটুকু অর্জনের জন্য বেসরকারি খাতের মুখাপেক্ষী হতে হবে।

অধিগ্রহণ: গত মে মাসে নতুন খসড়া প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট পলিসি-২০১১’তে বহুবার সংশোধন আনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এর নাম হয়েছে ‘ডিফেন্স অ্যাকিউজিশন পলিসি-২০২০’। এই নীতিমালার অন্যতম লক্ষ্য হলো- ভারতকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরির অন্যতম কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলতে এ খাতে উৎপাদন ও অধিগ্রহণে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা।

বর্তমান অধিগ্রহণ নীতিমালার মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো- ক্ষতিপূরণ দেয়া অথবা সরবরাহকারীদের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক তৈরি এবং ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাছে চূড়ান্ত পর্যায়ের পণ্য পৌঁছে দিতে বিনিয়োগ করা। তবে এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন খুব ধীরগতিতে হয়ে থাকে।

নতুন খসড়া অধিগ্রহণ নীতিমালায় আন্তঃসরকার চুক্তিতে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে ফ্রান্স থেকে রাফাল ক্রয়ের চুক্তিতে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও ভবিষ্যতে একই ধরনের চুক্তিতে এ শর্ত থাকবে না। এমনকি রাশিয়া থেকে যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত, সেখানেও এ ধরনের শর্ত থাকবে না। আর জরিমানার প্রয়োজন না হলে ভারত থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে ইচ্ছুক বিদেশি কোম্পানিগুলোকেও স্থানীয়ভাবে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে না।

‘ভারতীয় কোম্পানি’র নতুন সংজ্ঞা

খসড়া অধিগ্রহণ নীতিমালায় ‘ভারতীয় কোম্পানি’র সংজ্ঞা বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়নি। যখন এফডিআই সীমা ৭৪ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হলো, তখনো এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ‘ভারতীয় কোম্পানি’ বলতে সেখানে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। 

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, যে কেউ বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর এসব কোম্পানি ভারতের বাইরে থেকেও যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী যোগ করতে পারবে। এমনকি যেসব পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কোনো উৎপাদনকারীর যদি ভারতে সাবসিডিয়ারি থাকে, তাহলে তারা এসব পণ্য ভারতেই নানাভাবে তৈরি করতে পারবে। 

এ বিষয়টিকে পেছনের দরজা দিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রবেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর এসব কারণে প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার লক্ষ্যমাত্রা শুধু প্রধানমন্ত্রীর কথার কথাই হয়ে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //