আর্থিক মন্দার পথে ভারত

আগে থেকেই ধুঁকে ধুঁকে চলা ভারতের অর্থনীতি করোনাকালে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটের মুখে পড়েছে। এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে (কোয়ার্টার) ভারতের অর্থনীতি নজিরবিহীনভাবে ২৩.৯ শতাংশ সংকোচিত হয়েছে, যা ভারতের স্বাধীনতার পর কখনো হয়নি। 

ভারতের সাবেক প্রধান পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেনের মতে, এই সংকোচনের পরিমাণ ছিল ৩২ শতাংশ। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই পরিমাণটি ছিল আরো বেশি। জুলাই-সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারেও যদি অর্থনীতির এই সংকোচনের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে ভারত সরকারিভাবে আর্থিক মন্দায় পড়বে। 

রেটিং সংস্থা ক্রিসিলের আশঙ্কা, স্বাধীনতার পর চতুর্থবার মন্দার সম্মুখীন ভারত এবং এই মন্দা হয়তো সবচেয়ে তীব্র হবে। সংস্থাটির মতে, পরের কোয়ার্টারগুলোতে অর্থনীতি খানিকটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও পুরো অর্থবছরে ভারতীয় অর্থনীতি ৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভারত ইতিমধ্যে আর্থিক মন্দায় প্রবেশ করেছে।

সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছেন, ‘এখনো কেন্দ্রীয় সরকার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই জাতীয় সংকট মোকাবেলায় যেভাবে সরকারের ত্রাণে অর্থ বরাদ্দ করা দরকার, তার কিছুই তারা করেনি। দরকার ছিল উৎপাদন বাড়ানোর নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা। তার কিছুই হয়নি। প্রথম দিকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও, এখন তারা সব উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়েছে। অধোগতিতে চলে যাওয়া দেশের অভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না নিলে যে গুরুতর ক্ষতি হয়ে যাবে, তা মেরামতও অসম্ভব হয়ে পড়বে।’

অমানবিক লকডাউনের জেরে অতিমারি ছড়িয়ে পড়ার আগেই অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরীক্ষা, সূত্র অনুসন্ধান, আইসোলেশন ও চিকিৎসা- যা ব্যয়সাপেক্ষ হলেও রোগ-প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। এসব না করে কেন্দ্রীয় সরকার কোনো সতর্কীকরণ ছাড়াই সারাদেশকে স্তব্ধ করে দেয়। প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিক, যারা নিজেদের জীবিকা হারালেন, কোনো ক্ষতিপূরণ বা সামাজিক সুরক্ষা পেলেন না। অভিবাসী শ্রমিকরা ভয়ংকর দুর্দশার মধ্যে ঘরে ফিরতে বাধ্য হলেন। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে চিকিৎসাব্যবস্থা অপ্রতুল, ভাইরাস সেখানেও ছড়িয়ে পড়ল। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের পরিবার শিকার হয় পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্যহীনতার। এখন তাদের কাজে ফিরতে বলা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কম মজুরিতে, যদিও ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে গেছে আগের চেয়ে বহুগুণ। 

অর্থনীতিবিদ প্রভাত পাটনায়েক বলেন, ‘লকডাউন ঘোষণার প্রথম ধাক্কাতেই কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। সরকারি প্যাকেজে বলা হয়েছিল দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষকে প্রতি মাসে পাঁচ কেজি করে চাল দেয়া হবে; কিন্তু খুব দ্রুতই ওই প্রকল্প ঝিমিয়ে পড়ে। বিশাল জনসংখ্যার ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল ওই সাহায্যের ভাগ পেয়েছিল।’

মহামারি ঠেকাতে গত ২৫ মার্চ থেকে লকডাউনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোৎপাদন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। ১ জুন থেকে ধীরে ধীরে লকডাউন ওঠা শুরু হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানায় উৎপাদন, কর্মসংস্থান তৈরিতে তেমন গতি আসেনি। সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট- কৃষি ছাড়া বাকি সব শিল্প ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কলকারখানায় উৎপাদন কমেছে আশাতীত। শুধু কৃষিক্ষেত্রেই ৩.৪ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে। রবিশস্যের আশানুরূপ উৎপাদন ও যথেষ্ট বৃষ্টিপাত কৃষিকে রক্ষা করেছে ঠিকই, তবু ব্যাপক আয়সংকোচনের ফলে কৃষিমূল্য কৃষকের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হবে কি না, বা কৃষিকাজ তার কাছে যথেষ্ট লাভজনক থাকবে কি না, তা একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এক কোয়ার্টারে অর্থনীতি প্রায় ২৪ শতাংশ সংকোচন ছিল করোনাকালে জি-২০ দেশগুলোর মধ্যেই শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সবচেয়ে খারাপ ফল। তবে এই পরিসংখ্যান বাস্তবচিত্রের বেশ কিছুটা রক্ষণশীল প্রতিফলন। জাতীয় আয়ের প্রকৃত সংকোচন আরও ভয়াবহ। শিল্প উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবভিত্তিক সূচকে দেখা যাচ্ছে ২০ শতাংশের বেশি পতন। অন্যদিকে, অসংগঠিত খাতে সংকোচনের হার ছিল আরও বেশি। বহু অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ আজও হয় বন্ধ, নয়তো তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এর অর্থ, একদিকে কর্মসংস্থান যেমন কমছে, তেমনি কমছে মজুরিও। 

অর্থনীতিতে মহামারির প্রভাব কমাতে কেন্দ্রীয় সরকার পাঁচ দফায় মোট ২১ লাখ কোটি টাকার যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, অর্থনীতিতে তার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- গত বেশ কিছু মাস ধরে মানুষের ভোগব্যয় কমছে এবং গত এপ্রিল-জুন কোয়ার্টারে ওই ব্যয় অর্ধেকের বেশি (৫৪.৩ শতাংশ) কমে গেছে। অথচ, ২০১৯ সালের ওই কোয়ার্টারে ভারতে ভোগব্যয় বেড়েছিল ৫৬.৪ শতাংশ। আয়, কর্মসংস্থান হারিয়ে মানুষ ভোগব্যয় কমানোর ফলে বাজার থেকে ক্রেতা চাহিদা কমে গেছে। গাড়ি-বাড়ির মতো অত্যাবশ্যক নয় এমন পণ্যের বিক্রি কমেছে সবচেয়ে বেশি।

এই প্রসঙ্গে মোদি সরকারের আচরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রাজন বলেন, ‘কেন্দ্র সরকার ও তার আমলাদের দিক থেকে মহামারিতে অর্থনীতির ক্ষতিকে খুবই খাটো করে দেখা হচ্ছে। তাই হয়তো তারা এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে না। তারা হয়তো টাকা মজুদ রাখছেন সংকট আরও বাড়লে খরচ করার জন্য। অথচ পরিকল্পনাহীন অবস্থায় সংকট বেড়েই চলেছে।’

যখন যুক্তরাষ্ট্র তার জিডিপির ১০ শতাংশ, জার্মানি ৫ শতাংশ, জাপান তারও বেশি অর্থের ত্রাণ প্যাকেজ বরাদ্দ দিয়েছে; তখন ভারতের বরাদ্দ মাত্র ১ শতাংশ। আর ওই প্যাকেজেরও একাংশ বাজেটের সময়ে বরাদ্দ করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ভারত অন্যান্য বড় অর্থনীতির দেশগুলোর চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন; যেখানে ভয়াবহ লকডাউন ঘোষণার পরও জনগণকে খুব সামান্যই ভাইরাসমুক্ত রাখা সম্ভব হয়। বরং এতে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে ভারতের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করে দেশটির কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকার। আর লকডাউন উঠিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সবখানেই করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে, তবে এখানেও ভারতের কথাটি ভিন্ন। যে কোনো দেশের তুলনায় এখন আক্রান্ত বৃদ্ধির তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। জানা গেছে, চলতি অর্থবর্ষের এপ্রিল-জুন কোয়ার্টারে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ আট হাজার ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে, যা বার্ষিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৩.২ শতাংশ কম।

সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এসব প্রকল্পে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত। এতে গ্রামে চাহিদা বাড়ানো সম্ভব। শহরের ক্ষেত্রে গরিব মানুষকে নগদ অর্থ দেয়ার ব্যবস্থা করার পক্ষেও তারা বলেছেন। 

অর্থনীতিবিদ রাজন বলেছেন, ‘লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে চলায় বাজারে বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, মল যেখানে তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছল মানুষ তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ খরচ করে থাকেন, সেখানেও বিক্রিতে ভাটার টান। মহামারির প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য মানুষ কেনাকাটায় বেরুচ্ছেন না বললেই চলে। ফলে অর্থনীতি যে সংকটে পড়েছে, তা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক জয়তী ঘোষ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুতে লেখা এক নিবন্ধে বলেন, ‘যা প্রত্যক্ষ করে আরও ভয় হয়, সেটি হলো- এখন সমস্যার মাত্র সূত্রপাত হয়েছে। রোগের বিস্তার বন্ধ হয়ে যাবে, এমন ভাববার কোনো কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের তরফে নেই জনস্বাস্থ্য বা অর্থনীতি বিষয়ক কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। আর্থিক মন্দা এই কোয়ার্টারকেও নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত করতে চলেছে। সম্ভবত বছরের বাকি মাসগুলোও এর প্রভাবে আক্রান্ত হবে। সুতরাং আমরা যে স্বাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ আর্থিক সংকটের দিকে তাকিয়ে আছি, তা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //