বাইডেন যুগ কেমন হবে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক

আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন জো বাইডেন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কি হবে, তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। 

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র শাসনের দায়ভার পান, সেসময় পূর্বসূরিদের আমলে না নিয়ে নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে নিজ দেশকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছিলেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। এ নীতি অনুসরণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতির বহুপক্ষীয় স্থিতাবস্থায় পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে ইতিবাচক-নেতিবাচক রূপান্তর ঘটেছে। 

এখন বাইডেনের জয়ে নড়েচড়ে বসছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন আমলে হয় শক্তিশালী হবে কিংবা নতুন মোড় নেবে, আশা দেশগুলোর। আর পররাষ্ট্র নীতিতে বাইডেন ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি রাখবেন বলেই বিভিন্ন দেশের হর্তাকর্র্তাদের প্রত্যাশা।

ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়। এ অবস্থায় বাইডেনের শাসনামলে ঠিক কেমন হবে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক। 

সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (আরএসআইএস) রিসার্চ ফেলো আবদুল বাসিত বলেন, বাইডেনের শাসনামলে দুই দেশের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব কম। তবে এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এ পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে নিজ স্বার্থ নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে ওয়াশিংটন। ২০ বছর ধরে চলমান আফগান যুদ্ধে নতুন আকার পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করছেন বাইডেন। হোয়াইট হাউসে তার উপস্থিতি দুই দেশের পারস্পরিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে ওয়াশিংটনের সাথে ইসলামাবাদকে নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।  

তিনি বলেন, বাইডেন ট্রাম্পের মতো নন, পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা রয়েছে তার। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বেশ কয়েকবার তিনি পাকিস্তান সফরে গিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে কেরি-লুগার বারম্যান অ্যাক্ট-২০০৯ পাসের বিষয়ে সিনেটর জন কেরির সাথে বাইডেন ছিলেন এর অন্যতম কারিগর। এই আইনের আওতায় ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে পাকিস্তানকে ১৫০ কোটি ডলার সহায়তা প্রদানের পথ তৈরি হয়েছিল। তবে ট্রাম্প কখন কী করবেন, সে সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা করা যায় না। তিনি ক্ষণে ক্ষণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মতামত পরিবর্র্তন করে বিভ্রান্তি তৈরি করেন। এর বিপরীতে বাইডেন প্রতিষ্ঠান বা নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে বিশ্বাসী। সে হিসেবে বাইডেনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। 

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে রয়েছে চীন ও ভারত। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প ও দেশটির বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার পথ রোধ করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে কৌশলগত ও ভূরাজনীতির স্বার্থে ভারতের সাথেই সম্পর্কে বেশি গুরুত্ব দেবে বাইডেন প্রশাসন। কারণ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীন। আর চীনের সাথে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বেড়েই চলেছে। চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে ভারতের। 

গত মাসে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন বেসিক এক্সেচেঞ্জ অ্যান্ড কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট (বিইসিএ) স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তির আওতায় মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য, ক্ষেপণাস্ত্রসহ নানা সুবিধা নিতে পারবে ভারত। গত বছর ভারত ও পাকিস্তানের পুলওয়ামা-বালাকোট সংকটের সময় ট্রাম্পের পক্ষপাতমূলক প্রতিক্রিয়ায় দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক আরো জটিল করে দেয়।

বাইডেন নিঃসন্দেহে এই অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে ভারতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবেন। তবে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। সেইসাথে নতুন প্রেসিডেন্ট করোনাভাইরাস মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও পারমাণবিক কার্যক্রম কমানোর মতো বিষয়ে তার পূর্বসূরির চেয়ে বেইজিংয়ের প্রতি কম আগ্রাসী পন্থা গ্রহণ করবেন বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এখন অবধি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেকে অনেকটাই নিরপেক্ষ রাখতে পেরেছে পাকিস্তান। ফলে প্রয়োজনে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার যোগাযোগের সেতু হওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশটির। অতীতে পাকিস্তান এ ধরনের ভূমিকা সফলভাবেই পালন করেছে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ওয়াশিংটন ও বেইজিং সম্পর্কে স্থিতি আনতে ভূমিকা ছিল ইসলামাবাদের। ফলস্বরূপ ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেস্ট রিচার্ড নিক্সনের ঐতিহাসিক আনুষ্ঠানিক চীন সফর। এছাড়া  কাশ্মীরে ভারতের নিপীড়নমূলক নীতি সমালোচনায় বাইডেন প্রশাসন আরো সোচ্চার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক মহলে বিতর্কিত অঞ্চলে ভারতের মানবাধিকার  এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকে আরও দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরার সুযোগ পাবে পাকিস্তান। 

সেই সঙ্গে বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া সেন্সরশিপ ও সংখ্যালঘু নির্যাতনেরও সমালোচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত বছর পাকিস্তানকে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী দেশগুলোর তালিকাভুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন এ সমস্যা সমাধান করতে ইসলামাবাদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবেন। বাইডেনের শাসনামলে পাকিস্তান তার পারমাণবিক অস্ত্রাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়েও ওয়াশিংটনের কাছ থেকে বাড়তি চাপের মুখোমুখি হবে।

এত জটিলতা সত্ত্বেও বাইডেন যুগে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক ইতিবাচক পথে ধাবিত হতে পারে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে। আফগানিস্তান সরকার ও তালেবানদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে বোঝাপড়া হলে দেশটিতে যুদ্ধাবহ অবস্থায় পরিবর্তন আসবে। এ নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। তবে এ আলোচনা বিফল হয়ে জটিলতা পুনরুজ্জীবিত হলে তা প্রভাব ফেলবে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কে। 

এক্ষেত্রে আফগান সরকারের প্রতি বাইডেনের সমর্থন ট্রাম্পের চেয়ে বেশি থাকবে। তালেবানদের যুদ্ধ বন্ধে পাকিস্তানকেই মধ্যস্থতা করতে বাড়তি চাপ দেবে বাইডেন প্রশাসন। তবে এর অর্থ এ নয় যে, আফগানিস্তান সরকার ও তালেবানদের মধ্যে ক্ষমতা সংক্রান্ত চুক্তি হলেই ইসলামাবাদ-ওয়াশিংটন সম্পর্ক  সহজ থাকবে। বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিলেও তা হবে শর্তযুক্ত ও সময়সাপেক্ষ। ওয়াশিংটন দীর্ঘমেয়াদে আফগানিস্তানকে নজরদারিতে রাখতে পারে। এতে ইসলামাবাদের সাথে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। 

পাকিস্তানের সাথে চীনের সুদৃঢ় কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতি সচল রাখতে পকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রয়োজন হবে। ইসলামাবাদের বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ওয়াশিংটন। এ দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক ৬৫০ কোটি ডলারের ব্যবসা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা পেতে ইসলামাবাদেরও ওয়াশিংটনের সহযোগিতা প্রয়োজন। একইভাবে সন্ত্রাসী অর্থায়ন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যও ওয়াশিংটনকে প্রয়োজন পাকিস্তানের। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেশি প্রবেশাধিকার পেতে বাইডেন প্রশাসনের সাথে পাকিস্তনের আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

আবদুল বাসিত বলেন, পাকিস্তানকে অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে বাইডেন যুগ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিটি পুনঃনবায়ন করলে ইরান থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস ও তেল আনতে পারবে পাকিস্তান। এতে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পথ পাবে; কিন্তু অলস বসে বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আশা করলেই চলবে না। বাইডেন প্রশাসনকে আরো বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী করতে পাকিস্তানের উচিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন এবং ব্যবসানীতি সংস্কার করা। 

সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে বাইডেনের জয় পাকিস্তানের জন্য নিঃসন্দেহে সুসংবাদ; কিন্তু ওয়াশিংটনে নেতৃত্বের এ পরিবর্তনকে দেশের জন্য ইতিবাচক করতে ইসলামাবাদকে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //