বিস্ময়কর দৃঢ়তায় ভারতের কৃষক আন্দোলন

ভারতের নতুন কৃষি আইন ও চলমান কৃষক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে আন্দোলন যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে ততই ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের চরিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। 

এরই মধ্যে আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তাবাহিনী, মিডিয়া ও বিচার বিভাগের কৃষকবিরোধী অবস্থান এই আন্দোলন উন্মোচন করেছে। এত বাধার মুখেও জাত-পাত, সম্প্রদায় ও ভিন্নমতের সমন্বয়ে গঠিত দীর্ঘতর এ আন্দোলন সমহিমায় অগ্রসরমান থেকে বিস্ময় ও আশাবাদ জাগিয়েছে সাধারণ জনগণের মনে।

এরই মধ্যে গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের ট্র্যাক্টর র‌্যালি নিয়ে সরকারি মহলে মাথাব্যথার শেষ নেই! পুলিশের বেঁধে দেয়া রুট থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ট্র্যাক্টর চালিয়ে পুলিশকে ভয় দেখানো, লাল কেল্লায় ঢুকে পড়া, সেখানে পতাকা টাঙানোতে মূলধারার মিডিয়াগুলো ‘গেল গেল’ রব তুলেছে। অথচ গত দুই মাসে যখন আন্দোলনে শামিল প্রায় দেড়শ’ কৃষক মারা গেছেন দিল্লির সীমান্ত ঘিরে বসে থেকে, তখন ওই সংবাদমাধ্যমগুলো এসব কথা তোলেনি, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির সরকারের সামনে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।

এদিকে, নতুন কৃষি আইন ও তার বিরুদ্ধে সংগঠিত গণ-আন্দোলনে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করেছে। প্রতিবাদী কৃষকরা কখনো তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতের হস্তক্ষেপ দাবি করেনি। কাগজ-কলমে সরকার পক্ষও আদালতে যায়নি। আদালতে গেছে তৃতীয় পক্ষ। তাদের মধ্যে একাংশ আন্দোলনকারীদের সরাতে নির্দেশ আনতে আইনের শরণাপন্ন হয়। আরেকটি অংশ নতুন আইনগুলো সংবিধানসম্মত কি-না, তা বিচার করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হন। 

আন্দোলনের সাথে যুক্ত সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব বলেন, ‘কৃষক নেতারা কখনোই সরকারের সাথে আলোচনা করতে অস্বীকার করেননি, কারণ তারা বিশ্বাস করেন, সমস্যা সমাধানের জন্য এটি অন্যতম গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। আর কৃষি আইনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায় যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের, তাই তারা কখনো আন্দোলন ও আলোচনার প্রক্রিয়ায় আদালতের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন অনুভব করেননি।’

সর্বোচ্চ আদালতের যে সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তা হলো- নতুন কৃষি আইনের প্রয়োগ স্থগিত রাখা ও সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতের ইচ্ছানুযায়ী একটি কমিটি গঠন করা। ভারতের সংবিধানে আদালতের যে ইতিকর্তব্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার সাথে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় (অনুচ্ছেদ ৩২, ১৩১-১৩৪, ১৩৬) এটি স্পষ্ট যে, সরকার দ্বারা প্রণীত কোনো আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্ক শুনবেন, তারপর সংবিধানের আলোকে আইনটি বৈধ না অবৈধ সেই ব্যাপারে রায় শোনাবেন; কিন্তু কোথাও এটি বলা নেই- আদালত তার ইতিকর্তব্য ভুলে বিবাদমান দু’পক্ষের মধ্যে ‘মধ্যস্থতাকারী’র ভূমিকা পালন করবেন। অথচ এই কমিটি গঠন করে আদালত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। 

গত ১৮ জানুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারে আইনজীবী প্রবীণ বর্মা এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যে অসঙ্গতিগুলো সামনে এনেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রথমত, এই অ্যাড-হক কমিটির সদস্যরা কিসের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন? দ্বিতীয়ত, এই সদস্যরা কি শুধু বিচারপতিদের ইচ্ছানুসারে কমিটিতে আসবেন? তৃতীয়ত, এই রকম কোনো নির্দেশ আছে কি, যে সদস্য নির্বাচন ও তাদের কর্তব্য নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে বিবদমান পক্ষগুলোর সাথে কি কোনো শলা-পরামর্শ করা হবে? চতুর্থত, কমিটির সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘স্বার্থের সংঘাত’ (Confict of Interest)-এর প্রশ্নটি কীভাবে বিবেচিত হবে?

আইনের কিছু পর্যবেক্ষক আরো একটি গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন। সেটি হলো- আইনটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ কি-না, তা নিয়ে কোনো শুনানি হওয়ার আগেই আদালত আইনের প্রয়োগকে কীভাবে স্থগিত করে দিতে পারেন? এটিও ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এসব প্রশ্ন নতুন মাত্রা পায় প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যদের নামের তালিকার মাধ্যমে। কমিটির প্রথম নামটি ভূপিন্দার সিং মান। এই কৃষক নেতা মনে করেন, ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য সংস্কার জরুরি। দ্বিতীয় নামটি অনিল গানওয়াত, যিনি এই বিতর্ক চলাকালীন একাধিকবার তার লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, আইনগুলো প্রত্যাহারের প্রশ্নই আসে না, কারণ তা কৃষকদের জন্য নিত্য-নতুন সুবিধা বয়ে আনবে। তৃতীয় নামটি অধ্যাপক অশোক গুলাটি। নয়া-উদারবাদী মডেলে ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে সাজানোর পক্ষে তিনি দীর্ঘদিন ধরে সাফাই দিয়ে চলেছেন। একটি লেখায় তিনি এমনও বলেছেন যে, নতুন কৃষি আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে ফসলের দামের ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের যে সামান্য সুযোগ আছে সেটিও রাখার দরকার নেই। চতুর্থ নামটি ড. পি কে জোশি, যার বক্তব্য হলো- আইনগুলোর সামান্য সংশোধন করারও দরকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা সম্ভব, এই কমিটির সুপারিশ কি হতে পারে!

শীর্ষ আদালতের আরেকটি রায় নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। সেখানে আদালত রায়ের প্রথম অংশে কৃষকদের প্রতিবাদের অধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে আন্দোলনস্থল খালি করার নির্দেশ দিতে অস্বীকার করেন; কিন্তু একইসাথে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৃদ্ধ ও নারীদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ও আন্দোলনের নেতৃত্বকে তাদের সরাতে নির্দেশ দেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ একদিকে যেমন পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি অপরদিকে কৃষিতে নারীদের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনার বিপরীতে আন্দোলনে নেতৃত্বকারী সংগঠন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা তাদের প্রেস নোটে বলেছে, ‘কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের মতোই ও এটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব কৃষকের আন্দোলন- তাই তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা লজ্জাজনক। আমরা কঠোর ভাষায় এই চেতনার বিরোধিতা করছি।’ 

গত ২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর র‌্যালির পর যে কেন্দ্র সরকার কৃষকদের ওপর চড়াও হবে, তা প্রায় নিশ্চিতই ছিল। সরকারপন্থী মিডিয়া একের পর এক মিথ্যা খবর প্রচার করা অব্যাহত রেখেছে। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকার ২৭ জানুয়ারি রাত থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত কৃষকদের ওপর পুলিশি হামলা শুরু করে। গাজীপুর সীমান্ত বিশালসংখ্যক পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। একদিকে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ, অন্যদিকে দিল্লি পুলিশ।

গাজীপুর সীমান্তে কৃষকরা পুলিশি ঘেরাওয়ের মধ্যেও স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তারা কোথাও পালিয়ে যাচ্ছেন না। ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের (বিকেইউ) নেতা রাকেশ টিকায়েত পরিষ্কার বলে দেন, যদি এই কৃষি আইনগুলো চালু হয়, তবে তিনি আত্মহত্যা করবেন। তার এই ঘোষণা ও ঘোষণার সময়কার অশ্রু যেন আগুনে ঘিয়ের কাজ করল। সে রাতেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ থেকে হাজার হাজার কৃষক রওনা দেন গাজীপুরের দিকে। 

যে পাঁচশ’টি সংগঠন একত্রে সংযুক্ত কিষান মোর্চা গঠন করেছে, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ সারা ভারত কৃষক সভার কেন্দ্রীয় সভাপতি অশোক ধাওয়ালে পিপলস ডেমোক্রেসি সাপ্তাহিকে এক নিবন্ধে এই অভূতপূর্ব সংগ্রামের ঐতিহাসিকতা নিয়ে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন। প্রথম ঐতিহাসিকতা হলো- এই আন্দোলনের ব্যাপকতা। ভারতের ইতিহাসে এত বিচিত্র ধারার, বিচিত্র মত-পথের এতগুলো সংগঠনের দুটি মাত্র কেন্দ্রীয় দাবির ভিত্তিতে এভাবে ঐক্য গড়ে তোলার পূর্ব ইতিহাস নেই। এমনকী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও এত বিচিত্র মতাদর্শের মানুষ এভাবে একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নজির সম্ভবত নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, এত বিচিত্র মতপথের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সর্বসম্মতির এমন দৃষ্টান্তও নেই।

দ্বিতীয় বিষয়- এর অবিশ্বাস্য শান্তিপূর্ণ চরিত্র। নানা অঞ্চল থেকে নানা মত-পথের লাখ লাখ মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন দিল্লি সীমান্তের নানা প্রান্তে, অথচ সবাই শান্তিপূর্ণ। যা অশান্তি হয়েছে, তার সবটুকুই সরকারের তরফে। জলকামান, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করা, লাঠি চার্জ, গ্রেফতারি, স্থানে স্থানে অবরোধ তৈরি করা, রাস্তা কেটে রাখা- সবই করেছে সরকার। কৃষকদের তরফে শান্তিভঙ্গের একটি উদাহরণও নেই। অথচ উস্কানি ছিল প্রতিনিয়ত।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ সত্য- এই সংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। হিন্দু, মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নানা ধর্মের মানুষ, অবিশ্বাসী মানুষ সবাই জড়ো হয়েছেন এই সংগ্রামের ময়দানে। এই অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম গড়ে উঠছে এমন সময় যখন ভারতজুড়ে রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যাগুরুবাদী ধর্মীয় উগ্রতার হুঙ্কারবাণী শাসক দলের নানা শিখর থেকে ভেসে আসছে। এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের পতাকা ঊর্ধ্বে তোলার মধ্য দিয়ে উগ্র হিন্দুত্বের সংখ্যাগুরুবাদী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধেই ধ্বনি তুলছে এই সংগ্রাম। এমন সচেতন অসাম্প্রদায়িক উচ্চারণও ভারতের ইতিহাসে বিরল।

সর্বশেষ যে কারণে এ আন্দোলন ঐতিহাসিক, তা হলো- এর রাজনৈতিক মর্মবাণী। এই সংগ্রাম শুধু কৃষক বা কৃষির লড়াই নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নরেন্দ্র মোদির সরকার যেভাবে একদিকে সংখ্যাগুরুবাদের সহিংস আক্রমণ ও অন্যদিকে সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ভারতের সাধারণতন্ত্রের ব্যবস্থা ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, এই কৃষক সংগ্রাম সেই রাজনীতির প্রতি এক আঘাত, যা এর বিপরীতে এক গণ-মানুষের পক্ষের রাজনীতির কথা সামনে নিয়ে এসেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //