দিল্লি দাঙ্গা: এক বছর পরেও তদন্ত অসম্পূর্ণ

মুসলিমরাই বেশি গ্রেফতার

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ঠিক এক বছর আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি। আর সেই দাঙ্গার বর্ষপূর্তিতে এসে অর্ধেকেরও বেশি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলেই জানা যাচ্ছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারির ওই দাঙ্গায় অন্তত ৪০ জন মুসলিম ও ১৩ জন হিন্দু নিহত হয়েছিলেন। যে অভিযুক্তদের এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যাই বেশি।

দাঙ্গাপীড়িতদের অনেকেই এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায় হিমশিম খাচ্ছেন।

এদিকে দিল্লির যে বিতর্কিত বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, তিনি চার্জশিটে অভিযুক্ত হননি। বরং বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিশ্র দাবি করেছেন, নিজের কোনো কাজের জন্যই তিনি অনুতপ্ত নন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে রাজধানী দিল্লির নানা প্রান্তে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়েই ছিলো- কিন্তু ২৩ তারিখ থেকেই শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে তা পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়। 

ওদিকে জাফরাবাদ, মুস্তাফাবাদ, ব্রিজপুরী-সহ বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট ও মসজিদ-মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া হয়- যেখানে নিহতদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন মুসলিম। প্রায় টানা পাঁচদিন ধরে চলে এই সহিংসতা, আর দিল্লির বিস্তীর্ণ একটা অংশ কার্যত মৃত্যুপুরীর চেহারা নেয়।

দাঙ্গার প্রায় এক বছর পরও দিল্লি পুলিশ অর্ধেকেরও বেশি মামলার তদন্তই শেষ করতে পারেনি।

দিল্লিতে দ্য প্রিন্টের সাংবাদিক অনন্যা ভরদ্বাজ দিল্লি দাঙ্গার মামলাগুলো ফলো করছেন প্রথম থেকেই। তিনি বলেন, দিল্লির দাঙ্গায় এপর্যন্ত মোট এক হাজার ৮৮১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬ শতাংশ বা ৬৫০ জন জামিন পেয়েছেন। আর যারা গ্রেফতার হয়েছেন তার মধ্যে ৯৫৬জন মুসলিম আর ৮৬৮ জন হিন্দু। অর্থাৎ মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি।

তিনি আরো বলেন, দাঙ্গার ঘটনায় মোট মামলা হয়েছিল ৭৫৫টি, যার মধ্যে ৪০৭টিতে তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে ও চার্জশিট পেশ করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশ অবশ্য মনে করছে কভিড মহামারির মধ্যেও এই অগ্রগতি বেশ সন্তোষজনক, বাকি মামলাগুলোতেও আগামী কয়েকদিনের ভেতরেই চার্জশিট পেশ হয়ে যাবে।

দাঙ্গার ঠিক পর পরই দিল্লি সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে বেশ কিছু ত্রাণ শিবির স্থাপন করা হয়েছিল, ঘরবাড়ি ও আশ্রয় হারানো বহু মানুষ সেখানে ঠাঁইও পেয়েছিলেন। কিন্তু এর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে করোনাভারইরাসের কারণে গোটা দেশে লকডাউন জারি হয়ে যায়, ফলে ত্রাণ শিবিরগুলোও পাট গুটিয়ে ফেলে।

দাঙ্গায় অনেক দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়ায় বহু পরিবারই তাদের রুটিরুজির উৎস হারিয়ে ফেলেন, এমন কী স্কুল পর্যন্ত জ্বলে ছাই হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় শিশুদের স্কুলে পাঠানোও। এমনই একজন দাঙ্গাকবলিত গৃহবধূ মুস্তাফাবাদের সামিনা বেগম। তিনি বলছিলেন, মাথা তুলে দাঁড়াতেই চার-পাঁচ মাস সময় লেগে গেছে। লকডাউনের মধ্যেও কোনো ক্রমে একটু একটু করে বাড়ির জিনিসপত্র অল্প অল্প জোগাড় করেছি, তবু এখনো অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। এখন ঘরের জিনিস কিনবো না কি বাচ্চাকে আবার স্কুলে পাঠাবো, সেটাই দুশ্চিন্তা। তবে আমরা আশা ছাড়িনি এখনো।

দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ এর মধ্যে আম আদমি পার্টির নেতা ও কাউন্সিলর তাহির হোসেন, অ্যাক্টিভিস্ট শার্জিল ইমাম বা জেএনইউ’র ছাত্রী দেবাঙ্গনা কলিতাসহ অনেককেই আটক করেছে।

তবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, যিনি দাঙ্গার আগে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।

মিশ্র গতকাল মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিবিসি হিন্দিকে বলেন, আমার কথায় যে দাঙ্গা উসকানি পায়নি সেটা আপনারা পুলিশ আর মিডিয়া রেকর্ডস পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন। আমার বাড়ির ছাদে অ্যাসিড বোমা আর পাথর-অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেলে আমাকেও গ্রেফতার করা হতো। আর আমি কোনো হেইট স্পিচও দিইনি, কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের নাম পর্যন্ত করিনি, আমার হাতে কোনো অস্ত্রও ছিল না। আমি শুধু বলেছি অমুক তারিখের ভেতর রাস্তা খালি করে দিতে হবে।

কপিল মিশ্র যে তার বিতর্কিত বক্তৃতার জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন, সেটাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

দিল্লি পুলিশের তদন্তের গতিপ্রকৃতি থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দিল্লিতে তখন যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, তাদেরই তারা দাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী বা উসকানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করছে। -বিবিসি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //