মিঠুনকে নিয়ে নিশ্চুপ, মমতার টার্গেটে মোদি-শাহ

কয়েকবছর আগেও তারা ছিলেন একই দলের সহকর্মী। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভার সংসদ সদস্য করেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তীকে। রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যসভার সংসদ সদস্য পদের মনোনয়ন প্রদান করে নবান্নে এসে বয়সে ছোট মমতার হাঁটু ছুঁয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন মিঠুন। সময় বয়ে গেছে। সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৃণমূলের সাংসদের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন মিঠুন। রাজনীতি থেকেই সন্ন্যাস নিয়েছিলেন তিনি।

রবিবার (৭ মার্চ) সেই মিঠুন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, এইদিনটা তার কাছে এক স্বপ্নের মতো। কারণ, তিনি নরেন্দ্র মোদির সাথে একই মঞ্চে রয়েছেন। মিঠুনের ওই উচ্ছ্বাস প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যে শিলিগুড়িতে বক্তৃতা করতে উঠেন মমতা। প্রত্যাশামতোই কড়া আক্রমণ করলেন মোদি ও মোদির ব্রিগেডকে; কিন্তু মিঠুন নিয়ে একটি শব্দও শোনা গেলো না তাঁর মুখে। কারণ কী, তা কেউই জানেন না। ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, রবিবার বিকেল পর্যন্ত তেমন খবর নেই। ব্রিগেডের সভায় মিঠুন নতুন স্লোগান দিয়েছেন, ‘এক ছোবলেই ছবি!’ বলেছেন, তিনি ‘জাত গোখরো’। ছবির জনপ্রিয় ‘ডায়ালগ’ মনে করে ছাড় দেয়া যেতে পারে; কিন্তু এমন ভাষায় মিঠুনকে সাম্প্রতিককালে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায়নি।

রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মিঠুন বলেন, ‘আরে একটা স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম যে, আমি গরিবদের জন্য কিছু করবে। আজ মনে হচ্ছে, কোথাও যেন সেই স্বপ্নটা দেখতে পাচ্ছি। এটা হবেই। কারণ স্বপ্ন শুধু দেখার জন্য নয়। তা সফল হওয়ার জন্যই আসে। কেউ যদি হৃদয় দিয়ে দেখতে স্বপ্ন সফল হবেই।’

ব্রিগেড থেকে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, শিলিগুড়ি থেকে তার উত্তর দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘মোদি যখন ফাঁকা ব্রিগেডে, আমি তখন রাস্তায়। কারণ রাস্তাই আমাকে রাস্তা দেখায়।’ মোদি বারবার বলেছেন, ‘বাংলায় এবার আসল পরিবর্তন হবে।’ পাল্টা মমতার হুঁশিয়ারি, ‘বাংলায় পরিবর্তন করতে পারবেন না। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারই থাকবে। তার আগে দিল্লিতে পরিবর্তন হয়ে যাবে।’

শিলিগুড়িতে রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে মিছিল ও সভার আয়োজন করে তৃণমূল। সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মমতা। শেষে শিলিগুড়ির সফদর হাসমি চকে একটি সভাও করেন। আর সেখান থেকেই ব্রিগেডে মোদির ভাষণের সরাসরি জবাব দেন তিনি। বলেন, ‘এবারের নির্বাচন অস্তিত্ব রক্ষার নির্বাচন। অস্তিত্ব রক্ষা করতে না পারলে বাংলা ভাগ করবে বিজেপি।’

সভার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর বাংলা সফর নিয়ে আক্রমণ করেন তৃণমূল নেত্রী। বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে শুধু কুৎসা করতে আসেন। ব্রিগেডে বাংলা নিয়ে কথা বলার আগে তার উচিত রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জবাব দেয়া। কেন গ্যাসের দাম বাড়ছে? পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ছে? মোদিকে আগে সেই জবাব দিতে হবে। রান্না ঘরে আগুন লাগালে মা-বোনেরা ছেড়ে কথা বলবেন না।’ 

রবিবার মমতার মিছিলে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মমতার পাশেই ছিলেন মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহান, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, দোলা সেন-রা। ব্রিগেডে যখন মোদি ভাষণ দিতে শুরু করে দিয়েছেন, ততক্ষণে সভামঞ্চে পৌঁছে যান মমতা। তার বেশ কিছু সময় পর ভাষণ শুরু করেন। ভোটের মুখে বারবার প্রধানমন্ত্রীর বাংলায় আসা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, ‘যখন করোনার প্রকোপ চলছিলো, তখন ভয়ে ঘরে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আমি তখন সারা রাজ্যে ঘুরেছি, হাসপাতালে গিয়েছি। আর এখন কভিডের টিকায় মোদির বড় বড় মুখ দেয়া হচ্ছে। আসলে সবই জুমলা। একদিকে রেল, এয়ার ইন্ডিয়া, কোল ইন্ডিয়া বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে উজ্জ্বলা যোজনায় দুর্নীতি হচ্ছে। মোদির ভোটের আগে উজ্জ্বলা, ভোটের পরে জুমলা।’

ব্রিগেডের সভায় যখন পরপর বিজেপি নেতারা রাজ্যের নারী নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন; তখনই মমতার পাল্টা জবাব, ‘বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের থেকে অনেক বেশি সুরক্ষিত বাংলার মহিলারা।’

কৃষি আইন, প্রধানমন্ত্রী আবাস প্রকল্পের মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কথা টেনে তৃণমূল সরকারকে বারবার আক্রমণ করে বিজেপি। সেই সূত্রেই তৃণমূল নেত্রী বললেন, ‘কন্যাশ্রী, রূপশ্রী রাজ্য সরকার দিয়েছে। দরকার হলে এবার পাকাবাড়িও বানিয়ে দেবে। আপনার দেয়া পাকাবাড়ি দরকার নেই।’

উত্তরবঙ্গে লোকসভা ভোটের ফলের বিচারে বেশিরভাগ কেন্দ্রেই জয় পেয়েছে বিজেপি। তবে বিমল গুরুং-এর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা মমতার পাশে দাঁড়ানোয় উত্তরবঙ্গে ভালো ফলের আশা করছে তৃণমূল। বিধানসভার প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করার সময় উত্তরবঙ্গের তিনটি কেন্দ্র ছেড়ে রাখেন মমতা। প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পর উত্তরবঙ্গের প্রথম সফরে লোকসভা নির্বাচনের কথা স্মরণ করে দিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বলেছিলো, সব চা বাগান খুলে দেবে। আপনারা ভোট দিয়েছেন। কিন্তু একটাও চা বাগান খোলেনি। এখন রাস্তা তৈরি করতে এসেছে। রাস্তা তো তৈরি হয়ে গেছে, নতুন করে কী রাস্তা তৈরি করবে?’

সূত্র মতে, মিঠুন বাংলার বিধানসভা ভোটে বিজেপির হয়ে সক্রিয়ভাবে পদচারণ করবেন। মিছিল এবং জনসভাও করবেন। তবে তিনি সম্ভবত ভোটে দাঁড়াবেন না।

মিঠুনের বক্তব্য শুনে তাকে একদিকে যেমন অভিভূত এবং আপ্লুত মনে হয়েছে, তেমনই মনে হয়েছে, অনতি-অতীতের রাজনীতির তিক্ত স্বাদ তার মুখে এখনো লেগে রয়েছে। যা তিনি পিছনে ছেড়ে আসতে চেয়েছেন। এটা ঘটনা যে, মিঠুনও তার পুরনো দল বা নেত্রী সম্পর্কে একটি শব্দও বলেননি। সেটা সম্ভবত তারও ব্যক্তিগত সৌজন্য। কিন্তু যিনি রাজনীতিতে থাকবেনই না ভেবেছিলেন, তিনি যেভাবে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এবং আপ্লুতি দেখিয়েছেন সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়।

কারণ, তাকে ‘যুবহৃদয় সম্রাট’ বলে অভিহিত করেছেন বিজেপির প্রথমসারির নেতা শমীক ভট্টাচার্য। আর তাকে বিশ্বজনীন ‘দাদা’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন সংসদ সদস্য অর্জুন সিংহ), তা তার প্রাক্তন সহকর্মীদের নজর এড়িয়ে না গিয়ে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মমতাসহ কেউ কিছু প্রকাশ্যে বলেননি।

এমনিতে মমতা তার দলের ‘তারকা’ রাজনীতিকদের ‘অতিথি’ হিসাবেই দেখেন। অতীতেও তাকে একাধিকবার বলতে শোনা গেছে, ‘ওরা আমাদের অতিথি। ওরা অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজ করেন। ওরা আমাদের দলে এসেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ।’

পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, তাদের কেউ দল ছেড়ে চলে গেলেও মমতা তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। কিন্তু কোনো পেশাদার রাজনীতিক তৃণমূল ছেড়ে চলে গেলে মমতা চাঁছাছোলা ভাষায় তাদের আক্রমণ করেছেন। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলেন শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, সেই ‘সৌজন্যবোধ’ থেকেই মমতা মিঠুনকে নিয়েও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। তার দলের নেতারা অবশ্য ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে চেয়ে মিঠুনকে প্রকারান্তরে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলতে চেয়েছেন।

তাদের বক্তব্য, রাজ্যসভার সংসদ সদস্য হওয়ার পর মিঠুন বলেছিলেন, ছোটবোন মমতার দেয়া ওই সম্মান তিনি কোনো দিন ভুলবেন না। মমতার প্রতি তিনি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন। মিঠুনের বিজেপি যোগ দেয়ার জল্পনার সমান্তরালে বলিউড সুপারস্টারের ওপর প্রকারান্তরে সেই ‘চাপ’ তৈরি করা শুরু হয়েছিল; কিন্তু দেখা গেলো, মিঠুন সে সবের তোয়াক্কা করেননি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //