পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিয়ানার জয়

খেলাটা জমেছিল ভালো। বিজেপি সাম্প্রদায়িক আস্ফালন শুরুর আসকারা দিচ্ছিল। হানাহানি, দাঙ্গা, ধর্মীয় বিভেদ রচনা করে একটা বিষবাষ্প ছড়ানোর বীজ রোপণ করে। এই লক্ষ্যে গোটা ভারতবর্ষ থেকে নৈপুণ্য দেখাতে সক্ষম সব সাম্প্রদায়িক নেতাকে পশ্চিমবঙ্গে জড়ো করেন। তারা ভোটের যুদ্ধে টাকা বিছিয়ে দিয়ে নেতা-অভিনেতাদের কিনে নেন; কিন্তু মমতা ব্যানার্জি পাল্টা চাল দেন। কালচারের মধ্যে একটা বিভক্তি রেখা টানেন। বাঙালি বনাম অবাঙালি। গুজরাট থেকে আসা নরেন্দ্র মোদি কিংবা উত্তর প্রদেশের অমিত শাহের কালচার যে পশ্চিমবঙ্গে চলবে না সেই বার্তা দেন। শুরু হয় খেলা। একদিকে সাম্প্রদায়িক বিজেপি অপরদিকে অসাম্প্রদায়িক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির তৃণমূল কংগ্রেস। এই খেলায় আপাতত তৃণমূল জয়ী হয়েছে।

রাজনীতি তথা ভোটযুদ্ধ হলেও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন ছিল মূলত সাংস্কৃতিক লড়াই। মমতা ব্যানার্জি যখন বলেন, ‘জয় বাংলা’; তখন মোদি ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন, ‘সোনার বাংলা’। মোদির ভাঙা ভাঙা বাংলা উচ্চারণে হাসাহাসির শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুভাস বসুৃ যে বাংলা সংস্কৃতির ধারক; সেই জায়গায় বাঙালি সংস্কৃতির ওপর বিজেপি হানা দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বিজেপিকে ঠেকাতে সবাই একাট্টা হয়েছিল। ফলে তৃণমূল নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়। এতটা তৃণমূলের নেতারাও কল্পনা করেননি। বাঙালি ট্রাম্প কার্ড সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে এতটা কার্যকর হবে, সেটা খোদ মমতা ব্যানার্জিও ভাবতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় মোট ২৯৪ আসনের মধ্যে ২১৩ আসনে জয়ী হয়ে তৃণমূল কংগ্রেস রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠনের জন্য ১৪৮ আসন প্রয়োজন। মমতা ব্যানার্জি যদিও প্রায় ২০০ আসন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন; কিন্তু তিনি মূলত মোটামুটি সরকার গঠনে সন্তুষ্ট থাকার মতো মানসিক প্রস্তুতি রেখেছিলেন। বাঙালি ও অবাঙালি সংস্কৃতির বিভাজনের কারণে পশ্চিমবঙ্গের ভোট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কংগ্রেস কিংবা বামপন্থীরা কোনো আসনে জয়ী হতে পারেনি। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা যদিও তৃণমূলকে পছন্দ করে না; কিন্তু তাদের রাজনীতির বৃহত্তম ধারা বিজেপিবিরোধী। কংগ্রেস ও বাম নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। ভালোবেসে দেননি, বিজেপি ঠেকাতে ভোট দিয়েছেন। বিজেপিবিরোধী ভোট ভাগ হতে দেননি। বিজেপিকে তারা কতটা ভয় পেয়েছিলেন, তার প্রমাণ মুর্শিদাবাদে পাওয়া গেছে। মুর্শিদাবাদে কখনই বামপন্থী ছাড়া অন্যরা বিজয়ী হতে পারেননি। এবার ব্যতিক্রম। এবার সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। বিজেপির ঝড় ঠেকাতে বামেরা তৃণমূলে আশ্রয় নিয়েছেন। বাঙালি চেতনার শক্তি অকল্পনীয়।

বিজেপি প্রত্যাশার তুলনায় খারাপ ফল করলেও আগের চেয়ে ভালো করেছে। আগের বিধান সভায় বিজেপি তিনটি আসন পেয়েছিল। এবার তারা ৭৭টি আসন পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংস্থা- আরএসএস যার ভাবধারায় বিজেপি পরিচালিত হয়; তারা বাংলাদেশের আশপাশের রাজ্যগুলোতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তাদের অবস্থান শক্ত করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে। সেই মোতাবেক, কট্টর বিজেপি নেতা অমিত শাহকে দায়িত্ব দেয়। তার ফলও পেয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনে তারা ১৮টি আসনে জয়ী হয়। আগের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল। তখন থেকে বিজেপি উচ্ছ্বাস পোষণ করে যে, তারা পশ্চিমবঙ্গে বিধান সভা নির্বাচনেও ভালো শুধু নয়; রীতিমতো সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখে। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলেও, তারা এই অঞ্চলের রাজনীতিতে অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে। আসামে জয়ী হয়েছে। ত্রিপুরায় জয়ী হয়েছে। এবার পশ্চিমবঙ্গে অনেক আসন পেয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ৩০ শতাংশ। উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকাতে সংখ্যালঘুরা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। বিজেপি ক্ষমতায় যেতে না পারায় সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন আপাতত নিয়ন্ত্রণে। তারা জয়ী হলে পশ্চিমবঙ্গে তুলকালাম হয়ে যেতো বলে অনেক বিশ্লেষকের ধারণা। 

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিজয়ী হতে না পারার কারণে বাংলাদেশের মধ্যে বেশ স্বস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। ভৌগোলিকভাবে কাছে শুধু নয়; বরং ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মীয়তার বন্ধন ভারতের এই রাজ্যটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে এত আলোড়ন, এত আলোচনা। বাংলাদেশের অনেকের ধারণা, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় গেলে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই সহজ হতো। কারণ ভারতে বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা চুক্তি সই করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে চুক্তিটি সই করা সম্ভব হচ্ছে না। বিজেপি গেলে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি সহজেই সরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল; কিন্তু বিজেপি যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তা তিস্তা চুক্তির প্রাপ্তি দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়ার আশঙ্কা থাকে। 

মমতা ব্যানার্জি সব সময়েই তিস্তাকে ভোটের ইস্যু বানানোর চেষ্টা করেছেন; কিন্তু বাস্তবে তিস্তা ইস্যু ভোটের মাঠে কাজ করেনি। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল এলাকাগুলোর আসনে বিজেপি ভালো করেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করার সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সর্বাত্মক সহায়তা করে চুক্তিটি করান। এতে করে তার ভোটের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। মমতা ব্যানার্জি তিস্তা ইস্যু বোঝার জন্য কল্যাণ রুদ্র নামের একজন বিশেষজ্ঞ দিয়ে তিস্তার ওপর একটি গবেষণা করান। তিনি তার প্রতিবেদনে তিস্তা চুক্তি সই করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। কল্যাণের বক্তব্য হলো, নদীর পানি আটকে রাখলে হিতে বিপরীত হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন হচ্ছেও তাই; কিন্তু দেখা গেল, মমতা ব্যানার্জি তার করা বিশেষজ্ঞের অভিমত আমলে নিলেন না। তিস্তা চুক্তি করার ব্যাপারে তার আপত্তি অব্যাহত রাখলেন। আমরা সবাই আশা করি, এবার মমতা ব্যানার্জির তিস্তা চুক্তি সই করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //