‘ডেল্টা প্লাস’ ধরনে ভারতে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা

প্রতিদিন আক্রান্ত হতে পারে ৫ লাখ

ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের রেশ কাটতে না-কাটতেই তৃতীয় ধাক্কার বার্তা নিয়ে উপস্থিত ‘ডেল্টা প্লাস স্ট্রেন’। ‘ডেল্টা’ ধরন নিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই নতুন ধরনটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যেই ভারতের আট রাজ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে ওই নতুন স্ট্রেনটি।

মূল করোনাভাইরাসের থেকে চরিত্র বদল করা ডেল্টা প্লাস স্ট্রেনটি সংক্রমণের নিরিখে ব্যাপক শক্তিশালী। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, একবার ওই স্ট্রেন ছড়াতে শুরু করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কার্যত দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই ডেল্টা প্লাস স্ট্রেনের কারণে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে ব্রিটেনে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, পোলান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, জাপানসহ নয়টি দেশে ডেল্টা প্লাস ছড়িয়ে পড়েছে। 

ভারতে ইতিমধ্যেই আটটি রাজ্যে ৪০ জন আক্রান্ত হয়েছেন ওই স্ট্রেনে। দুশ্চিন্তার বিষয় হল, এত দিন যে পদ্ধতিতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা হয়ে এসেছে, ডেল্টা প্লাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে তা-ও কাজ করছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ডেল্টা প্লাসের সংক্রমণকে একেবারে শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দ্বিতীয় ঢেউয়ের চেয়েও বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। 

করোনার তৃতীয় ঢেউ ভারতে ভয়াবহ আকার নিতে পারে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে মাসে। দৈনিক সংক্রমণের হার পৌঁছে যেতে পারে পাঁচ লাখে। এমনই আশঙ্কার কথা জানাল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি) কানপুর। তৃতীয় তরঙ্গ সংক্রান্ত তিন ধরনের আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে সেই গবেষণায়।

‘সাসেপটিবল-ইনফেকটেড-রিকভার্ড’ বা ‘এসআইআর’ মডেলে গবেষণাটি চালানো হয়েছে কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে। এক. টিকাদানের ভূমিকাকে বাদ রাখা হয়েছে পরিসংখ্যান থেকে। দুই. ধরে নেয়া হয়েছে, দেশের সব মানুষের সংক্রমিত হওয়ার মাত্রা একই রকম। তিন. ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের সর্বত্র লকডাউন উঠে যাবে। 

এই তিনটি বিষয়কে ধ্রুবক ধরে তিন ধরনের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন গবেষক‌েরা। এগুলি হলো-

১. অক্টোবরে তৃতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছবে। দ্বিতীয় তরঙ্গের চেয়ে তার ভয়াবহতা কিছুটা কম হবে। দেশে দৈনিক ৩.২ লাখ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে সংক্রমণের হার।

২. করোনার নতুন ধরন আরো সংক্রামক আকার নেবে। সেপ্টেম্বরেই চরমে পৌঁছবে তৃতীয় ঢেউ। দেশে দৈনিক সংক্রমণের হার পৌঁছতে পারে ৫ লাখে।

৩. অক্টোবরের শেষে আছড়ে পড়বে তৃতীয় ঢেউ। সংক্রমণের মাত্রা দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো হবে না। সর্বাধিক ২ লাখের আশপাশে পৌঁছবে সংক্রমণের হার।

এই তিনটি ক্ষেত্রেই সংক্রমণ যে প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে বেশি ভয়াবহ হবে, তেমনই দাবি করা হয়েছে। আইআইটি কানপুরের দুই অধ্যাপক রাজেশ রঞ্জন ও মহেন্দ্র ভর্মার নেতৃত্বে যে গবেষকেরা এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন, তারা বলেছেন, টিকা দেয়ার বিষয়টিকে গবেষণায় গ্রাহ্য করা হয়নি। টিকাকরণের হার বাড়লে অবশ্যই তৃতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা কমবে। টিকাকরণের হার কেমন হলে, তৃতীয় তরঙ্গ কোথায় পৌঁছবে, তা নিয়ে আরো গবেষণা চলছে। ফল হাতে এলেই তা জানানো হবে।

এদিকে ডেল্টা প্লাসকে শুরুতেই রুখতে মহারাষ্ট্র, কেরালা ও মধ্যপ্রদেশকে সতর্ক করে দিয়েছে কেন্দ্র। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিঠিতে জানিয়েছে, মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি ও জলগাঁও, কেরালার পলক্কড় ও পঠানামথিট্টা এবং মধ্যপ্রদেশের ভোপাল ও শিবপুরী জেলার করোনা আক্রান্তদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ২২ জনের শরীরে ডেল্টা প্লাস স্ট্রেনের সন্ধান পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবারই (২২ জুন) মহারাষ্ট্র, কেরালা ও মধ্যপ্রদেশকে সতর্ক করেছিল কেন্দ্র।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব রাজেশ ভূষণ জানিয়েছেন, শুধু মহারাষ্ট্রেই ভাইরাসটির এই নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে ২১ জনের শরীরে। তামিলনাড়ুতে ও কেরালায় তিনজন করে আক্রান্ত হয়েছেন এই ধরনে। কর্নাটকে কয়েকজনের মধ্যে থাবা বসিয়েছে এই ধরন। অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও জম্মুতে একজনের শরীরে ডেল্টা প্লাসের উপস্থিতি দেখা গিয়েছে।

ডেল্টা প্লাস ধরনটির সংক্রমণ বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাজ্যগুলোকে পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।

নীতি আয়োগের সদস্য (স্বাস্থ্য) বিনোদ পাল বলেন, অন্যান্য দেশে ডেল্টা স্ট্রেনের কারণে অনেকে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এই স্ট্রেন দ্রুত গতিতে ছড়ায় ও খুব অল্প সময়ে বহু মানুষকে আক্রমণ করে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেল্টা প্লাস স্ট্রেনের সম্পর্কে বিশদে এখনো জানা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এই স্ট্রেন আগামী দিনে কী ভাবে চরিত্র বদল করবে, তা নিয়েও কারও বিশেষ কোনো ধারণা নেই। ভারতে টিকাদানে ব্যবহৃত মূল দু’টি প্রতিষেধক কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন ডেল্টা স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কার্যকরী হলেও ডেল্টা প্লাসের বিরুদ্ধে সেগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনো তেমন কিছুই জানাতে পারেননি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। 

প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিন রাজ্যকে সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ব্যাপক সংক্রামক ডেল্টা প্লাস স্ট্রেনের ভাইরাস ফুসফুসের কোষকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকে। ফলে ফুসফুসের ক্ষতি হয় বেশি। এছাড়া এই স্ট্রেনের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ব্যাপকভাবে কমে যায়। সেই কারণে যে এলাকাগুলোতে ডেল্টা প্লাসের নমুনা পাওয়া গিয়েছে, সেখানে নজরদারি কয়েক গুণ বাড়ানো দরকার। 

চিঠিতে তিন রাজ্যের মুখ্যসচিবের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ওই এলাকাগুরোকে অবিলম্বে কনটেনমেন্ট জ়ন হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জিনোম সিকোয়েন্সের জন্য পরীক্ষা বাড়াতে হবে, আক্রান্তরা কাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তা দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে। ডেল্টা প্লাস ছড়ানো এলাকাগুলোতে একশো শতাংশ টিকাকরণে জোর দিতেও বলা হয়েছে। 

বিনোদ পাল বলেন, ‘তৃতীয় ঢেউ রুখতে হলে দরকার কঠোর কোভিড বিধি পালন ও দ্রুত টিকাকরণ।’

এদিকে আজ বুধবার (২৩ জুন) ভারতে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৫০ হাজার ৮৪৮ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ছাড়িয়ে গেল। মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩ কোটি ২৮ হাজার ৭০৯ জন। বিশ্বের দ্বিতীয় দেশে হিসাবে ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ছাড়াল। এর আগে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই ৩ কোটি ছাড়িয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা।

এছাড়া করোনায় ভারতে আজ মৃতের সংখ্যা একটু বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৩৫৮ জন রোগীর। এ নিয়ে দেশে মোট প্রাণ হারিয়েছেন ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৬০ জন।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ভারতের দৈনিক সংক্রমণের হার কমছে। মঙ্গলবার ও বুধবার তা ৩ শতাংশের নিচে রয়েছে। তবে এর মধ্যেই চোখ রাঙাচ্ছে করোনার নতুন ধরন ডেল্টা প্লাস। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //