বিতর্কিত কৃষি আইন থেকে আপাতত সরলেন মোদি

দেশজুড়ে প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯ নভেম্বর ছিল শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের জন্মদিন। এ দিনটিকেই বেছে নেন মোদি। জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। 

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। 

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ওই তিনটি আইন পাসের পর থেকে রাস্তায় নেমে প্রবল বিক্ষোভে সোচ্চার হন লাখো কৃষক। দুই মাস বিক্ষোভের পরও যখন কৃষকদের কথায় সরকার কর্ণপাত করেনি, তারপর গত ২৬ নভেম্বর হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে কৃষকরা এসে ভিড় জমান রাজধানী দিল্লির সীমানায়। মাসের পর মাস ধরে দিল্লির সীমানা ঘেরাও করে চলে বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহারসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষক ও অন্যান্য শ্রেণি- পেশার মানুষ সেখানে জড়ো হন। কংগ্রেসসহ বিজেপিবিরোধী একাধিক দলের নেতারাও বিক্ষোভে পাশে ছিলেন শুরু থেকেই।

নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি ওঠে সর্বত্র। এমনকী আইন বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। শীর্ষ আদালত অবশ্য ওই তিনটি কৃষি আইন কার্যকরের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে।

এ দিকে কেন্দ্রের তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের পিছনে অন্য কারণ দেখছে বিশেষজ্ঞ মহল। আগামী বছরের শুরুতেই বছর ঘুরলেই গোবলয়ের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। বিধানসভা ভোট রয়েছে পঞ্জাব, গোয়াতেও। সদ্য সমাপ্ত উপ-নির্বাচনগুলোতে একাধিক রাজ্যে বিজেপির ফল ভালো হয়নি। সেইসঙ্গে কৃষক সংগঠনগুলো মোদি সরকারকে চাপে রাখতে দিল্লি সীমান্তেই শুধু নয়, তারা ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে গ্রামে গ্রামে সমাবেশ আয়োজন শুরু করেন। আর বিজেপি-বিরোধীদের কণ্ঠ চাপা দিতেই মোদি সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া : কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার পর ২০ নভেম্বরকে দেশব্যাপী ‘কিষাণ বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করে কংগ্রেস। দলটির নেতা সোনিয়া গান্ধী লিখেছেন, ‘আজ সেই ৭০০ পরিবার, যাদের সদস্যরা কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মত্যাগ মূল্য পেল। আজ সত্য, ন্যায় এবং অহিংসার জয় হয়েছে।’

রাহুল গান্ধী এক টুইট বার্তায় লেখেন, ‘কেন্দ্রের অহঙ্কারের বিরুদ্ধে কৃষকদের সত্যাগ্রহের জয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে আসা এই জয়কে অভিনন্দন।‘এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, চলতি বছর জানুয়ারিতেই কংগ্রেস সাংসদ দাবি করেছিলেন, কৃষি আইন নিয়ে পিছু হটবে কেন্দ্র। আমার কথা লিখে রাখুন।’ সেই ভিডিও তার টুইটের সঙ্গে পোস্ট করেছেন রাহুল গান্ধি।

সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির মন্তব্য, ‘কেন্দ্রের স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্য কৃষকদের অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। সাত শতাধিক কৃষকদের আত্মত্যাগ আমরা ভুলবো না। সরকার যাদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে, এই জয় তাদের।’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বলেছেন, ‘বিজেপির নিষ্ঠুরতায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিরলসভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়া কৃষকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই জয় আপনাদের। এই লড়াইয়ে যাঁরা তাঁদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা রইল।’

তিন কৃষি আইন বাতিলকে সমর্থন জানিয়েছে শিব সেনা, অকালি দলের মতো সাবেক এনডিএ শরিকরাও। 

সাবধানতায় কৃষক : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও এখনই আন্দোলনের রাশ আলগা করতে চাইছেন না কৃষক নেতারা। সংসদে শাসক দলের আচরণ কেমন থাকে, সেটি পর্যালোচনা করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে কৃষক সংগঠনগুলো।

ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের জাতীয় মুখপাত্র রাকেশ টিকায়েত বলেন, ‘সংসদে কৃষি আইন বাতিল হওয়ার আগে ফিরে যাব না। তারপর আমরা এমএসপি নিয়ে আলোচনা শুরু করব। বড় প্রশ্নচিহ্ন এখন এমএসপিতেই।’ 

উল্লেখ্য, নতুন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল প্রায় সর্বত্র। এমনকী আইন বাতিলের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। শীর্ষ আদালত অবশ্য ওই তিনটি কৃষি আইন কার্যকরের ওপর আগেই স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও আগামী ২৭ নভেম্বর পূর্ব ঘোষণা মতোই লক্ষে্‌নৗ শহরে কৃষক মহাসম্মেলন আয়োজন করবে সংযুক্ত কৃষক মোর্চা।

আন্দোলনে জয় পাওয়ার পর কৃষক নেত্রী হরিন্দর কৌর বিন্দু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আজ আমি ভীষণ ভীষণ খুশি। এত দিন ধরে যে কালো আইন ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা আন্দোলন করে চলেছি, উনি (প্রধানমন্ত্রী) যে সেটা ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন, তাতে আমরা খুবই খুশি। আমরা আমাদের বিশ্বাসে অনড় থেকেছি, যার জন্য ওরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন। এই বিজেপি সরকার কৃষকদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল। আমরা কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়েছি। আমাদের ৭০০ জন সাথী শহীদ হয়েছেন। সব ঋতুতে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা আমরা রাস্তায় বসে আন্দোলন চালাচ্ছি। তাই এই আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই খুশি তো হবই। গান-বাজনা, নাচ, দোকানদাররা সবাইকে খাবার বিলিয়েছেন, মিষ্টি খাওয়ানো হয়েয়ে- আমরা জয় উদযাপন করেছি আজ।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘‘যে বিজেপি সরকার দেশের মানুষের উপর রাজত্ব চালাচ্ছে, তারা আসলে করপোরেটের হয়ে কাজ করছে, দেশবাসীর উপর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিয়ম-কানুন চাপাতে চাইছে- আমরা তো এমনিই ওদের বিশ্বাস করি না। আমরা জানি, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, মাথা সজাগ রাখতে হবে। একটা কথা সত্যি যে, আমরা আর আগের মতো নেই। মানুষ অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে, সচেতন হয়েছে, প্রশ্ন না করে কিছু মানতে চায় না মানুষ এখন আর। এখনো আমাদের গ্রামে মানুষ বলছে- ‘মোদির উপর ভরসা করো না। এর কথার কোনো ঠিক নেই। যে কোনো সময়ে বদলে যেতে পারে। কারণ সে তো নাটক করে সারাক্ষণ!’ মানুষ এখন এগুলো জানে। আমরা মোটেও তার মুখের কথায় ভুলছি না, আন্দোলন তুলছি না। এমন নয় যে উনি ঘোষণা করলেন আর আমরা দিল্লি থেকে যে যার জায়গায় ফিরে গেলাম। আমরা এমএসপি গ্যারান্টি, বিদ্যুৎ বিল সংশোধনসহ আরও অন্যান্য যে দাবি রয়েছে, তার আইনি দিক স্পষ্ট করে, সেগুলো প্রত্যাহার করে তবেই ফিরব।”

তবুও থাকছে শঙ্কা : ভিন্নপথে এই আইন বাস্তবায়ন করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। উত্তর প্রদেশের উন্নাও নির্বাচনি আসনের বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ ২০ নভেম্বর বলেন, ‘বিল তৈরি হয়, প্রত্যাহার হয়, ফের ফেরত আসে, আবার বিল তৈরি করা হয়। এটা সময়ের খেলা।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। উনি আইনের আগে দেশকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যারা ক্রমাগত সমালোচনা করে গিয়েছেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান তুলেছেন, তাদের যোগ্য জবাব দিয়েছেন।’ 

এমনকি, কৃষি বিল প্রত্যাহারের সঙ্গে উত্তর প্রদেশ ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই। এই দাবি করে বিজেপি সাংসদ বলেছেন, ‘আগামী ভোটে উত্তর প্রদেশে বিজেপি তিন শতাধিক আসন পাবেই। এর কোনো ব্যতয় হবে না। কারণ নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগীজির কোনো বিকল্প তৈরি হয়নি।’

শুধু সাক্ষী মহারাজ নয়, কৃষি বিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিতর্ক বাড়িয়েছেন রাজস্থানের রাজ্যপাল কলরাজ মিশ্র। এসব মন্তব্যের বিপরীতে অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টির পক্ষ থেকে দেওয়া এক টুইট বার্তায় বলা হয়, ‘বোঝাই গেল বিজেপির মন পরিষ্কার নয়। ভোটের পরে ফের এই বিল ফিরিয়ে আনা হতে পারে। সংসদীয় পদে বসে থাকা ব্যক্তি এবং বিজেপি সাংসদের মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট কেন্দ্রের অবস্থান।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //