‘কাঁটাতারের বেড়া টপকে আসা সব হিন্দু-মুসলিমকে ফিরে যেতে হবে’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, যে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ঢুকেছে, তাকে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে যেতে হবে। সে হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক।

যদিও বিজেপির এই নেতা বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করেননি। তবে মালদা জেলার ওই জনসভায় দেওয়া বক্তৃতা শুনে মনে করা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা মানুষদের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। 

বিজেপি এতদিন বলে এসেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা হিন্দুদের উদ্বাস্তু আর মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। শুভেন্দু অধিকারীর ভাষণের পরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দুরা ভারতে এসেছেন, তাদেরও কি ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে?

শঙ্কা হিন্দুদের মনে

শুভেন্দুর ভাষণের ক্লিপটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এমন এলাকায়, যেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা অনেক মানুষ বসবাস করেন।

কলকাতা লাগোয়া এরকমই এক এলাকা যাত্রাগাছি। যেখানে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজন বসবাস করেন। তাদের মধ্যে হিন্দুরা বড় সংখ্যায় হলেও মুসলমানরাও থাকেন সেখানে।

তাদের বেশিরভাগই এখন ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন এবং বিজেপি ওই অঞ্চলে যথেষ্টসংখ্যক ভোট পায়। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও গিয়েছিলেন ওই এলাকার একটি বাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে। ওই পাড়াতে এখন শুভেন্দুর ভাষণ নিয়েই আলোচনা চলছে।

এলাকার এক বাসিন্দা, যিনি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে ১৯৮৬ সালে চলে এসেছিলেন ভারতে, তিনি নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলেন, আমরা তো এটা নিয়েই আলোচনা করছি। শুভেন্দু অধিকারীর ভাষণটা সবাই দেখেছি।

‘আমাদের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ভাষণটা শোনার পরে যে এতবছর ধরে তিল তিল করে এদেশে সব গড়ে তোলার পর যদি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়াব।’

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা শুভেন্দু অধিকারীর মুখ থেকে যখন এমন কথা শোনা যায়, তাহলে তো চিন্তা হয়ই।

আবার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার এক বাসিন্দা যিনি নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে এখানকারই নাগরিক হয়ে গেছেন, তিনি বলছেন, ‘আমার তো কোনো আশঙ্কা হচ্ছে না ওই ভাষণ দেখার পর।

প্রথম ব্যক্তি সরাসরি রাজনীতি না করলেও দ্বিতীয় ব্যক্তি বিজেপির সমর্থক। তার কথায়, আমার মনে হয় যে শুভেন্দু অধিকারী হয়ত আবেগের বশে বলে ফেলেছেন। কিন্তু হিন্দুদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে, এটা হতে পারে না। বিশ্বের সব হিন্দুদের আশ্রয়স্থল এই দেশ। নাগরিকত্ব আইন বদল করেছে যারা, তাদের তাড়ানো হবে না।

নীতিতে বদল হয়নি

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করার সময় থেকেই তাদের নীতি ছিল বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে যেসব হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈনরা ভারতে চলে এসেছেন বা আসতে চান ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে, তাদের ভারতে উদ্বাস্তু বলে চিহ্নিত করা হবে এবং তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, জনসংঘের সময় থেকে এ নিয়ে আমাদের যে নীতি তাতে কোনো বদল হয়নি।

তিনি বলেন, যারা নিজেদের ধর্ম রক্ষার তাগিদে, সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে, জীবন রক্ষার তাগিদে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, আমাদের দেশে এলে তারা নাগরিকত্ব পাবেন এবং উদ্বাস্তু হিসাবে তাদের দেখা হবে। তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে দেখা হবে না। এটা জনসংঘের সময় থেকেই নীতি ছিল, পরে যখন বিজেপি গঠিত হল, ওই মূল নীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তার কথায়, আমরা এই মতাদর্শগত নীতিকে কখনই লঘু করতে দেব না। এই কারণেই সিএএ, এনআরসির কথা বলা হয়েছে।

শমীক ভট্টাচার্য বলেন, যারা একদিন ভারতকে নাপাক বলে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তান নামক একটা রাজনৈতিক মস্তিষ্ক-প্রসূত রাষ্ট্রের দাবি করে, যার জন্য বলি হয়েছিল লাখ লাখ মানুষ, তারা ভারতে এলে তো অনুপ্রবেশকারীই বলতে হবে। কারণ তাদের মসজিদে তো কেউ আগুন লাগিয়ে দেয়নি, তাদের বাড়ির মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে কেউ বিয়ে করছে না বা ধর্মান্তরিত করছে না।

শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য নিয়ে ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, বক্তব্যটা একটু ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

উদ্বাস্তুরা নাগরিক নন

উদ্বাস্তু নেতারা বলছেন, এখনও যে লাখ লাখ মানুষ, যারা ১৯৪৭ সাল থেকে অনেক দশক ধরে ভারতে চলে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কেন বিজেপি কোনো স্পষ্ট নীতি নিচ্ছে না?

উদ্বাস্তু নেতা সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, উদ্বাস্তু প্রশ্নে বিজেপি একেক সময়ে একেকটা কথা বলে। যখন যেখানে ভোটের জন্য যেরকম প্রয়োজন সেভাবেই কথা বলেন তারা। শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্যকে সেভাবেই দেখছি আমরা।

তিনি বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে গত সাড়ে সাত দশক ধরে যারা এসে পড়েছে ভারতে, তাদের একটা বিরাট অংশ এখনও নাগরিকত্ব পায়নি। বাংলাদেশ থেকে মূলত সেদেশের সংখ্যালঘুরাই তো এসেছে, তাদের ফিরে যাওয়া সম্ভবও না। তাই আমাদের দাবি, যারা এসে গেছে, তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। তারা বলছে সিএএ করে নাগরিকত্ব দেবে। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, সে কথা আমরা বারবার বলেছি। সেই প্রেক্ষিতে শুভেন্দু অধিকারীর এ রকম কথার বিরোধিতাই করছি আমরা।

সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশভাগের পর থেকে প্রায় দুই কোটি মানুষ ভারতে এসেছেন, যাদের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এখনও আইনত অনাগরিক। যদিও পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা উদ্বাস্তুরা নিজেরাই স্বীকার করেন, তাদের প্রায় সবাই কোনও না কোনও পথে ভারতের নাগরিকত্ব ‘যোগাড়’ করে নিয়েছেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //