পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের গ্রেপ্তারের সময়কাল

রাজনৈতিক উত্তেজনা ও রাজনীতি সংক্রান্ত অমীমাংসিত নানা অধ্যায়ে জরাজীর্ণ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশ পাকিস্তান। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, কোনভাবেই দেশটিতে রাজনৈতিক স্থবিরতার দেখা মেলাই যেন ভার। আর এই ধারাবাহিকতায় মাত্র তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার হলেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান। শনিবার(৫ আগস্ট) ইসলামাবাদের একটি আদালত ইমরানের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত তোশাখানা দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পরেই তার লাহোরের জামান পার্কের বাসা হতে গ্রেপ্তার হন তিনি। 

এর আগে মে মাসের ৯ তারিখ ইসলামাবাদের হাইকোর্ট আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

পাকিস্তানের এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের কারাগারে রাখার দীর্ঘ ইতিহাস এর আগেও দেখা গেছে। যারা দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ভাগ্যে এমন পরিণতি এর আগেও বরণ করতে হয়েছে। আর এ নিয়েই দেশটির সংবাদমাধ্যম ডন ডট কম সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের একটি টাইমলাইন তুলে ধরেছে, যেখানে কিনা দেখা যায় কোনও না কোনও সময় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে ছিলেন তারা। 

১৯৬০’র দশক :

জানুয়ারি ১৯৬২: পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী (সেপ্টেম্বর ১৯৫৬-অক্টোবর ১৯৫৭) ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের বিষয়টিতে তার অসমর্থন জানালে ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডারের (ইবিডিও) মাধ্যমে তাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইয়ুব সরকার। পরে ১৯৬০ সালের জুলাইয়ে ইবিডিও লঙ্ঘনের অভিযোগে অভুযুক্ত হলে ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেসময় পাকিস্তানের ১৯৫২ সালের নিরাপত্তা আইনের আওতায় ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে’ জড়িতের অভিযোগে করাচির কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় তাকে।

সত্তর দশক:

সেপ্টেম্বর ১৯৭৭: জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৩ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ১৯৭৪ সালে রাজনৈতিক এক প্রতিপক্ষকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িতের অভিযোগে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন তিনি। পরে লাহোরের হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ আহমদ সামদানি তাকে মুক্তি দিলেও এর তিন দিন পর মার্শাল ল রেগুলেশন-১২ এর আওতায় আবারও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশেষে ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আশির দশক:

আগস্ট ১৯৮৫: ১৯৯০ সালের আগস্ট  হতে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৯৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। জিয়াউল হকের একনায়কতন্ত্রের (১৯৭৭-১৯৮৮) সময় বেনজির ভুট্টো দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবেও সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৮৫ সালের আগস্টে বেনজির ভুট্টোর ভাই মারা গেলে রাজনীতিতে সক্রিয় হন বেনজির ভুট্টো। পরে তাকে ৯০ দিনের জন্য গৃহবন্দী করা হয়।

আগষ্ট ১৯৮৬: করাচিতে স্বাধীনতা দিবসের এক সমাবেশে সরকারের নিন্দা জানানোর সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নব্বই দশক: 

মে ১৯৯৮: লাহোর হাইকোর্টের এহতেসাব বেঞ্চ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

জুন ১৯৯৮: দেশটির তৎকালীন ‘দ্য পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেয়। 

জুলাই ১৯৯৮: লাহোর হাইকোর্টের এহতেসাব বেঞ্চ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে আবারও জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

এপ্রিল ১৯৯৯: বেনজির ভুট্টোকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পাশপাশি অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুইস কোম্পানিকে শুল্ক জালিয়াতির সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে এহতেসাব বেঞ্চ তাকে সরকারি পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে। তবে আদালতের রায় ঘোষণার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। পরে অবশ্য উচ্চ আদালত ওই রায় বাতিল হয়ে যায়।

অক্টোবর ১৯৯৯: এহতেসাব বেঞ্চ সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় আদালতে হাজির না হওয়ায় বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে ফের জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

চলতি শতকের প্রথম দশক (২০০০) :

সেপ্টেম্বর ২০০৭: ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সরকার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দিলে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। পরে ২০০৭ সালে পাকিস্তানে ফিরেন তিনি। নওয়াজ শরিফ ইসলামাবাদে ফেরার পর সেখানকার বিমানবন্দর অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। সেসময় তিনি ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। ১০ বছরের নির্বাসনের বাকি ৩ বছর কাটানোর জন্য পরে তাকে সৌদি আরবের জেদ্দায় পাঠায় পারভেজ সরকার। 

নভেম্বর ২০০৭ : জেনারেল মোশাররফের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লং মার্চে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পাঞ্জাবে পিপিপি সিনেটর লতিফ খোসার বাড়িতে বেনজিরকে এক সপ্তাহের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

২০১০:

জুলাই ২০১৮: নওয়াজ শরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজকে ১০ বছরের সাজা দেয় দেশটির জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো (ন্যাব )। পরে হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে সাজা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় দুই মাস পর কারামুক্ত হন নওয়াজ শরিফ।

ডিসেম্বর ২০১৮: সৌদি আরবে ইস্পাতের কারখানায় পরিবারের মালিকানার বিষয়ে দায়ের হওয়া এক মামলায় শরিফকে সাত বছরের সাজা দেওয়া হলে আবারও কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। পরের বছরের নভেম্বরে চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়ার অনুমতি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। এরপর থেকে তিনি আর পাকিস্তানে ফেরেননি।

জুলাই ২০১৯: পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন শহীদ খাকান আব্বাসি।

২০১৩ সালে তিনি পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী থাকাকালীন কয়েক বিলিয়ন রুপির এলএনজি আমদানি বিষয়ক এক চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে ন্যাবের ১২ সদস্যের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে জামিন পান তিনি এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদিয়ালা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাকে।

 ২০২০:

সেপ্টেম্বর ২০২০: পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করে ন্যাব। সেসময় ন্যাবের অর্থপাচারের এক মামলায় লাহোরের হাইকোর্ট তার জামিন বাতিল হলে গ্রেপ্তার হন তিনি। প্রায় সাত মাস পর লাহোরের কোট লাখপাত কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

মার্চ ২০২৩: পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ইসলামাবাদের এক বিচারককে হুমকি এবং তোশাখানা উপহার সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে অংশ না নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ওই পরোয়ানা জারি করে আদালত।

মে ২০২৩: আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় দুর্নীতির অভিযোগে ৯ মে ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের চত্বর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৫ আগস্ট ২০২৩: শনিবার ইসলামাবাদের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত ইমরান খানকে তোশাখানা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছরের সাজা ঘোষণা করলে সকল নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। পাশপাশি আগামী পাঁচ বছরের জন্য ইমরান খানকে দেশটির সক্রিয় রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণাও করেছে আদালত।

সূত্র: ডন 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //