ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের নানা সমালোচনা করলেও কার্যত তিনি ও তার দল বিজেপি এই জোটকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। বরং জোট শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়ানোর আগেই এ নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন মোদি। এজন্য রাজ্য পর্যায়ের দলগুলোকে মামলা ও অভিযানের তোপের মুখে রাখা হয়েছে। এটিকে সরকারি দলের ভয়, সংশয় ও আত্মবিশ্বাসের অভাব বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর বিরোধী দলগুলোর ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের শেষ দিনে যৌথ ঘোষণা আসে সরকারবিরোধী আন্দোলনের। এর বিপরীতে মোদি সামনে আনেন ‘এক দেশ, এক ভোট’ নীতির প্রচার। এ ব্যবস্থা চালু করতে সাবেক প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করেছে মোদি সরকার। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলোপ, তিন তালাক নিষিদ্ধ করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আংশিক প্রয়োগ করে বিজেপির তিন মৌলিক ঘোষণা আংশিকভাবে কার্যকর করে ফেলেছেন মোদি। তার বাকি কাজ হলো— ২০২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) শতবর্ষে পা দেওয়ার আগে ভারতের সংবিধান বদলে দেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ ঘোষণার জন্য কাঠামো পরিবর্তনের কাজটি সেরে ফেলা। ‘এক দেশ, এক ভোট’ ব্যবস্থা প্রণয়ন সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ারই একটি প্রয়াস।
প্রস্তাবটি নতুন নয়। হিন্দু মহাসভার অন্যতম তাত্ত্বিক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাবনা ছিল— ‘এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান’। এর সঙ্গে ‘এক দেশ, এক ভোট’— এর কথাও বিজেপি বেশ কিছু দিন ধরে বলে আসছিল। ২০১৯ সালে মোদি ‘এক দেশ, এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন। যদিও বিরোধীদের মধ্যে তেমন সাড়া পাননি। তবে সব দল সহমত হলেও এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সহজ নয়। আবার ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মতো বিষয়টি বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়াও রহস্যজনক। ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামী নতুন এ ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, এই ব্যাপারে সহমতের ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।
এই ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকও রয়েছে। বলা হচ্ছে— সংযুক্ত নির্বাচন হলে পৃথক ভোটের বিপুল খরচ থেকে রেহাই মিলবে। ভারতের মতো গরিব দেশে খরচের বিষয়টি সত্যিই উপেক্ষা করার নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মোট খরচের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী এর ৪৫ শতাংশই খরচ করেছে বিজেপি ও তাদের প্রার্থীরা। মোদি কি তার দলের নির্বাচনী খরচে রাশ টানতে পারবেন? অথচ নির্বাচনী সংস্কার চাইলে সবার আগে অস্বচ্ছ ‘ইলেকটোরাল বন্ড’ বাতিল করা দরকার; দরকার ভোটে প্রার্থীর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোরও খরচের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া। যৌথ নির্বাচন নিয়ে ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশন একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওপি রাওয়াতের নেতৃত্বে। সেই কমিটির প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে ভারতেই নির্বাচন খাতে খরচ সবচেয়ে কম। ভোটার পিছু এক ডলার। আসলে নির্বাচনে সরকারি খরচের থেকে বেশি মাথাব্যথার কারণ বিজেপি ও তাদের সহযোগী দলের প্রচারব্যয়। কমিশনের তখনকার হিসাব অনুযায়ী সংযুক্ত নির্বাচন করতে হলে অন্তত ৩০ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হতো। কমিশনের হাতে ছিল অর্ধেকের কিছু বেশি। বাকি ইভিএমের জন্য তখনই খরচ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ২৮৪ কোটি রুপি। গড়ে একটি ইভিএম ১৫ বছর কার্যক্ষম থাকে। সংযুক্ত নির্বাচন হলে বিপুল টাকা খরচ করে কেনা ইভিএমগুলো ১৫ বছরে মাত্র তিনবার ব্যবহার হবে, এখন যা গড়ে ১০ বার ব্যবহার হয়।
নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোট হলো রাজনৈতিক লড়াইয়ের সর্ববৃহৎ কর্মকাণ্ড। ভোটের প্রচারের সুবাদেই রাজনৈতিক দলগুলো জনমনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। লোকসভা, বিধানসভার পৃথক নির্বাচন চালু থাকায় বিজেপি নেতারাও বেশি করে মানুষের কাছে যেতে পারছেন। প্রশ্ন হলো— তাহলে খরচ, লোকবল, সুরক্ষা, সময় ইত্যাদিতে সাশ্রয়ের নামে মোদি ও তার দল কেন সংযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বিজেপির লক্ষ্য শুধু ‘এক দেশ, এক ভোট’ নয়। তাদের স্বপ্ন, ‘এক দেশ, এক ভোট, এক দল’। নির্বাচনের মাধ্যমেই ভারতে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম করা। মোদি-শাহরা মনে করছেন, সংযুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন (লোকসভা ও বিধানসভায় একই দলের) সরকার প্রতিষ্ঠা আরও সহজ হয়ে যাবে।
এ কারণেই সংযুক্ত নির্বাচন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর। যুক্ত নির্বাচন হলে প্রচারে জাতীয় ইস্যুই প্রাধান্য পাবে, বড় দলগুলোর চাপে হারিয়ে যাবে আঞ্চলিক দলের বক্তব্য, রাজ্যবাসীর প্রত্যাশা। আঞ্চলিক দল, যারা রাজ্যের মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে সামনে রেখে লড়াই করে, সেই দলগুলো সংযুক্ত নির্বাচনে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে যাবে। এমনিতেই রাজনৈতিক কর্মকা- এখন অনেক বেশি নির্বাচনকেন্দ্রিক। সংযুক্ত নির্বাচন হলে ছোট ও আঞ্চলিক দলগুলোকে স্থবিরতা গ্রাস করবে, বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা তুলনায় কম। দেশবাসী, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে রাজনীতি বিমুখ করাও যৌথ নির্বাচনের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে— যেখানে সরকারের নীতি, পদক্ষেপের বিরোধিতা করার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। চলতি ব্যবস্থায় কোনো ভোটার লোকসভায় কোনো দলকে সমর্থন করার পর যদি দেখেন তারা প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ, তা হলে বিধানসভায় অন্য দলকে ভোট দিতে পারেন। সংযুক্ত নির্বাচনে সে সুযোগ থাকবে না এবং লোকসভা ও বিধানসভার জন্য পৃথক দলকে ভোটদানের সম্ভাবনা ক্রমেই কমে আসবে। বিজেপি এই ভরসাতেই মনে করছে, সংযুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা গেলে দাক্ষিণাত্য এবং পূর্ব ভারতের অধরা রাজগুলোর দখল নেওয়া সহজ হয়ে যাবে।
বিজেপি মিডিয়া ও আইটি সেল ব্যবহার করে তাদের প্রচারে দেশপ্রেমকে জাতীয়তাবাদের সমার্থক করে তুলেছেন। এসব প্রচারে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী শিবির ‘ভারত বিপন্ন’ প্রতিষ্ঠা করা গেলে বাংলা, বিহারের প্রতি বঞ্চনার ইস্যু নির্বাচনে দাগ কাটবে না, বলাই বাহুল্য। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে— ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ব্যবস্থাই চালু ছিল; কিন্তু সেই ভারতের সঙ্গে আজকের ভারতের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দেশ ভাগের সময়েও রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল ছিল; কিন্তু আজকের মতো শক্তিশালী ছিল না কোনো আঞ্চলিক দল। ১৯৬৭ সালের পর ভারতে আঞ্চলিক দলগুলো ভারতের রাজনীতি বদলে দিয়েছে। এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সংযুক্ত নির্বাচন চালু হলে। আর এর মধ্য দিয়ে বিজেপি ও সংঘ পরিবার ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার পথে আরও একধাপ অগ্রসর হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বিজেপি ভারত নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh